কুমারখালীর তাঁত শিল্পে কাজে ব্যস্ত এক শ্রমিক- সংবাদদাতা
কুমারখালী (কুষ্টিয়া) সংবাদদাতা
দিনকে দিন ঐতিহ্যের রঙ ফিকে হয়ে যাচ্ছে কুষ্টিয়ার কুমারখালাীর তাঁত শিল্পের। কারখানায় গ্যাস সঙ্কট, বিদ্যুৎ ও কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি এবং পৃষ্ঠপোষকতার অভাবটাই এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী। আর্থিক সঙ্কটে দেশজুড়ে জনপ্রিয় এই উপজেলার তাঁত শিল্প থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন ৫০ হাজার শ্রমিক, একের পর এক বন্ধ হচ্ছে কারখানা। এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা এখন জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তাঁত শিল্পের সঙ্গে জড়িত খয়েরচারা-ঝাউতলার সাহেব আলী জানান, উপজেলা জুড়ে হাতে গোনা কয়েকটি এলাকায় তাঁতের গামছা তৈরি হয় এখন। অব্যাহত লোকসান ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে স্থানীয় তাঁতের গামছা শিল্প। যদুবয়রার গামছার কারিগর আব্দুল গফুর বলেন, এক সময় উপজেলার তাঁত পল্লীগুলো তাঁতের খটখট শব্দে রাত-দিন মুখরিত থাকতো, আজ সেখানে নীরবতা। তবুও বাপ-দাদার পেশা আঁকড়ে কোনো মতে টিকে আছে কয়েকটি পরিবার।
তাঁতীরা জানিয়েছেন, এক সময় স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে রপ্তানি হতো এই উপজেলার তাঁতের চাদর, সেটার পাট্টা বেডশীট, তোয়ালে ও গামছা। আজ সেটার পাট্টা বেডশীট অনেকটাই স্মৃতি, সেই স্থান দখল করেছে প্রিন্ট চাদর। এভাবে চলতে থাকলে পাট্টা চেকের বেডশীটের মতো গামছাও হারিয়ে যাবে অচিরেই। তারা জানান, বর্তমানে তোয়ালের কদর বেশ বেড়েছে। অনেক কারখানা শুধু তোয়ালের উপর নির্ভর করে টিকে রয়েছে।
তাঁত বোর্ডের তথ্যানুসারে, জেলায় ১৫ হাজার পাওয়ার লুম ও ২ হাজার হ্যান্ডলুমে ১ লাখ ৪০ হাজার শ্রমিক কর্মরত রয়েছে। এই শিল্পের শ্রমিকরা করোনাকালে দুর্দিনের মধ্যে দিনাতিপাত করছেন। তাঁত মালিকরা রয়েছে অর্থনৈতিক সঙ্কটে। সুতা রং ও কাঁচামালের মূল্যে উর্ধগতি আর নানা প্রতিকূলতার কারণে এককালের প্রসিদ্ধ এই শিল্পে দুর্দিন চলছে। এই শিল্পের সাথে জড়িত শ্রমিকরা বাধ্য হয়ে অন্য পেশা বেছে নিচ্ছেন।
জানা গেছে, এক সময় কুমারখালী, খোকসা, কুষ্টিয়া মিরপুর, রাজবাড়ীর পাংশা, লাঙ্গলবাঁধ এলাকায় প্রায় ৮০ হাজারেরও অধিক তাঁতী ছিল। খটখটি তাঁত ১৪ হাজার, হস্তচালিত পিটলুম তাঁত ৪৪ হাজার ও বিদ্যুৎ চালিত ২০ হাজার তাঁত ছিল। এসব তাঁতে ২ কোটি ৮৮ লাখ পিচ লুঙ্গি, ১৫ লাখ পিস বেডকভার, ৭২ লাখ পিস গামছা-তোয়ালে উৎপাদন হতো। সেসময় এই জেলায় বস্ত্রশিল্পের বার্ষিক আয় ছিল ৩শ’ কোটি টাকার উপরে। দেশের মোটা কাপড়ের চাহিদার ৬৩ ভাগ পূরণ করতো কুমারখালীর তাঁতীরা। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত এই তাঁত কাপড়ের ছিল ব্যাপক চাহিদা। বর্তমানে এই চাহিদা কমে ৩৫ ভাগে নেমে এসেছে। কাপুড়িয়া হাট হারিয়েছে তার সুনাম-সুখ্যাতি। তাঁতী সমাজ মোটা লুঙ্গি তৈরি করে কোন মতো বেঁচে আছেন। কেউ কেউ শাহজাদপুরের মতো চিকন সুতির লুঙ্গি তৈরি করে কষ্টের মধ্যেই সংসার চালাচ্ছেন। তবে কুমারখালী শহরে ৪টি কাপড় প্রসেসিং মিল ও ৩টি ফিরোজা রংয়ের ডাইং বস্ত্র শিল্পে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ তাঁতবোর্ডের সেবা আশানুরূপ না পাওয়ায় ক্ষোভ রয়েছে ব্যবসায়ীদের।
ঐতিহ্যের এই শিল্পের গৌরব ফিরিয়ে আনতে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে নতুন করে ভাবতে হবে, বিনাসুদে ঋণ সুবিধাসহ নতুন কর্ম পদ্ধতি প্রণয়ন, পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে বলে মতামত দিয়েছেন তাঁত শ্রমিক, মালিক ও কুমারখালীর বস্ত্র ব্যবসায়ী সমাজ।
এমএস/এমকে