একদিকে আষাঢ়ের ভ্যাপসা গরম, অন্যদিকে বিদ্যুতের ভেলকি- এ দুই মিলে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেছে দেশবাসী। দীর্ঘদিন পর ঘন ঘন লোডশেডিং শুরু হয়েছে, প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে সেটা হচ্ছে ঘণ্টায় ঘণ্টাতেও। এতে ভোগান্তি পোহাচ্ছে সব বয়সের মানুষ, বিশেষ করে শিশু আর বৃদ্ধের অবস্থা ত্রাহি। সরকারি হিসাবেই বিদ্যুতের লোডশেডিং এখন সাড়ে ১২শ মেগাওয়াট। বিদ্যুৎ উৎপাদন ৩৫০০ মেগাওয়াট কমে যাওয়ায় শিল্পকারখানা ও আবাসিকে লোডশেডিং করতে হচ্ছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিদ্যুতের নিরবিচ্ছিন্ন সরবরাহে সরকারের সফলতা ফিকে হতে বসেছে। এদিকে বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।
প্রধানমন্ত্রী বলেন ‘বিদ্যুৎ আমরা ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছিলাম। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সবাই পাচ্ছিল। কিন্তু এখন আন্তর্জাতিক বাজারে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উপকরণগুলোর দাম অত্যাধিক বেড়ে গেছে। ডিজেল, তেল, এনএলজির দাম বেড়েছে। সব কিছুর দাম বেড়েছে। কয়লা এখন পাওয়া যায় না।’
মঙ্গলবার (৫ জুলাই) প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্টের (পিজিআর) ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপনের অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী আরো জানান, করোনার অভিঘাত আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে আজ সারা বিশ্বেই তেলের দাম বেড়েছে। অনেক দেশেই এখন বিদ্যুতের জন্য হাহাকার।
অন্যদিকে এ পরিস্থিতি খুব বেশিদিন থাকবে না আশা প্রকাশ করে প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, এ বছরের মধ্যেই পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউনিট, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং ভারত থেকে ১৬০০ মেগাওয়াট আমদানিকৃত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে।
বর্তমানে বৈশ্বিক জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংকট পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রতিমন্ত্রী বলেন, জাপানের মতো উন্নত ও অর্থনৈতিভাবে সমৃদ্ধ দেশও তাদের সাড়ে তিন কোটির বেশি মানুষকে নিয়মিত বিদ্যুৎ সুবিধা দিতে পারছে না। একই অবস্থা আরেক উন্নত দেশ অস্ট্রেলিয়ারও। ভারত-পাকিস্তানের কথা না হয় নাইবা বললাম। সবাইকেই এ সংকট সময়ে রেশনিং করতে হচ্ছে।
প্রতিমন্ত্রীক জানান, করোনার ধাক্কা যখন সবাই কাটিয়ে উঠছিল, তখনই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি সারা বিশ্বকে গভীর এক সংকটে ফেলেছে। যুদ্ধের প্রভাবে জ্বালানি মার্কেট চরম অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক খাদ্য পণ্যের বাজারও বেসামাল। বৈশ্বিক এ সংকট আমাদেরকেও বিপদে ফেলেছে।
দেশে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি সম্পর্কে নসরুল হামিদ জানান, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ১৬০০-১৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের প্রয়োজন। সেখানে যোগান দেওয়া যাচ্ছে মাত্র ৯০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের। কৃষি ও শিল্পখাতকে অগ্রাধিকার দেওয়ায় এর বেশি গ্যাস যোগান দেওয়া যাচ্ছে না বিদ্যুৎ উৎপাদনে। কৃষির জন্য অপরিহার্য সার উৎপাদনেও অনেক পরিমাণ গ্যাস দিতে হচ্ছে। তিনি জানান, বর্তমানে দৈনিক গ্যাসের উৎপাদন ২৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। বিদ্যুৎ খাতে চাহিদার বাকি বৃহৎ অংশ এলএনজি আমদানি করে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হচ্ছে। জানান, ২০০৯ সালে দেশে গ্যাসের উৎপাদন ছিল দৈনিক মাত্র ১ হাজার ৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট। উৎপাদন সক্ষমতা বাড়িয়ে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দৈনিক ২৭৫০ মিলিয়ন ঘনফুট পর্যন্ত গ্যাস উৎপাদন করা হয়েছে। কিন্তু খনিগুলোর রির্জাভ কমে যাওয়ায় নিজস্ব গ্যাস উৎপাদন কমতে শুরু করেছে। কাতার ও ওমানের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী চুক্তির আওতায় এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক স্পট মার্কেট থেকেও এলএনজি আমদানি করা হচ্ছিল। করোনার আগে এক ইউনিট এলএনজি ৪ ডলারেও আমদানি করা গেলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটা ৪১ ডলারও ছাড়িয়ে গেছে। এত উচ্চমূল্যে আমদানি করলে অর্থনীতির উপর বিশাল চাপ তৈরি হবে। শুধু গ্যাসের দামই না। বেড়েছে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম। ২০২১ সালের জুলাইয়ে ডিজেল ব্যারেল প্রতি ৭৭ ডলার থাকলেও এ বছরের জুনে সেটা ১৭১ ডলারে দাঁড়িয়েছে।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, সরকার নিজস্ব জ্বালানির অনুসন্ধান, উৎপাদন বৃদ্ধি এবং বিদ্যমান কূপগুলোতে আরো গভীরে খনন করে গ্যাসের অনুসন্ধান কাজ চালাচ্ছে। এরই মধ্যে আগামী ৩ বছরের একটা আপগ্রেডেশন, ওয়ার্কওভারের স্বল্প মেয়াদী পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, এত ৪৬টি কূপ থেকে দৈনিক ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস নতুন করে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হতে পারে বলে আশা প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের।
এমকে