নির্বাচন কমিশনের (ইসি) হাতেই জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সেবা রাখার পরামর্শ দিয়েছেন ইসির সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও নির্বাচন কমিশনাররা। তারা মনে করছেন, এ সেবা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গেলে ভোটার তালিকা নিয়ে গোলমাল হবে। ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএমে) ভোট নেওয়ার ক্ষেত্রেও জটিলতা সৃষ্টি হবে। সবচেয়ে বড় কথা ভোটার হওয়ার আগ্রহও থাকবে না সাধারণ মানুষের মধ্যে।
বুধবার (১৯ অক্টোবর) সাবেক সিইসি ও নির্বাচন কমিশনারদের নিয়ে বৈঠক করেন কাজী আব্দুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন বর্তমান ইসি। সাবেকদের অভিজ্ঞতা ও পরামর্শ শুনতেই এ বৈঠক ডাকা হয়। সেই বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বিষয়টি জানান ইসির সাবেকরা। রাজধানী ঢাকার আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে এ বৈঠক হয়, সভাপতিত্ব করেন কাজী আব্দুল আউয়াল। বৈঠকে সাবেক সিইসি, নির্বাচন কমিশনার ও ইসির সচিবসহ ১৪ জন অংশ নেন।
সাবেকরা বলেন, এনআইডি নির্বাচন কমিশনের তৈরি। ভোটার তালিকা থেকেই এনআইডি এসেছে। ভোটার হওয়ার চেয়ে এখন এনআইডির প্রতি আগ্রহ বেশি মানুষের। এটা ইসির হাতে থাকলে সরকারের কোনো অসুবিধা হয় না। কিন্তু এটাকে ইসির কাছে থেকে নিয়ে গেলে নির্বাচন নিয়ে কমিশনের কাজ করতে অসুবিধা হবে। কারণ, এনআইডির সঙ্গে ভোটার তালিকা ও ইভিএমে ভোট গ্রহণ প্রক্রিয়া জড়িত। এটা ইসির কাছে না থাকলে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে যদি ভোটার দেখেন এনআইডিতে একটি, ভোটার তালিকায় অন্যটা- তখন সমস্যা সৃষ্টি হবে।
তারা বলেন, এনআইডি সরকার কেন নিতে চাইছে- সেটা পরিষ্কার ও বোধগম্য নয়। এটা আলাদা হলে ভবিষ্যতে ভোটার তালিকা নিয়েও কথা উঠবে। রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার হবে। এনআইডিতে কোনো দুর্বলতা থাকলে সেটাকে ঠিক করা যেতে পারে। এটাকে আরও মজবুত করা উচিত বলেও পরামর্শ দেন সাবেকরা।
বৈঠকে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার আবদুর রউফ, কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ, কেএম নূরুল হুদা, সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম শাখাওয়াত হোসেন, শাহ নেওয়াজ, রফিকুল ইসলাম ও কবিতা খানম, সাবেক ইসি সচিব এমএ রেজা, সচিব মুহম্মদ সাদিক, সিরাজুল ইসলাম, মোহাম্মদ আবদুল্লাহ ও হেলালুদ্দীন আহমেদ প্রমুখ বক্তব্য দেন।
প্রসঙ্গত, এনআইডি সেবা নির্বাচন কমিশন থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলছে। গত ১০ অক্টোবর ‘জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন-এর খসড়া শর্তসাপেক্ষে নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এখন সেটা পাশের জন্য সংসদে ওঠবে। এ আইন পাশ হলে এনআইডি সেবা নির্বাচন কমিশন থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগের কাছে চলে যাবে। তখন জন্মের পর থেকেই শিশুদের এনআইডি দেওয়া হবে। আর এ সুরক্ষা বিভাগের ডাটাবেজ থেকে তথ্য নিয়ে অথবা নিজেরাও পৃথকভাবে ভোটার তালিকা করতে পারবে ইসি। তবে আইনটি পাশ হওয়ার আগ পর্যন্ত এ সেবা ইসির হাতেই থাকছে।
এদিকে জানা গেছে, বৈঠকে এনআইডি ইসির হাতে রাখার পাশাপাশি ভোটকেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা ব্যবহারের ওপর জোর দেন সাবেকরা। তবে ভোটগ্রহণে ইভিএম ব্যবহার নিয়ে সাবেক সিইসি ও নির্বাচন কমিশনারদের মধ্যে ভিন্ন মত উঠে আসে। কেউ বলেন, ইভিএম এ সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। এটিকে বাদ দেওয়া যাবে না। বিপরীতে কেউ বলেন, ইভিএম নিয়ে রাজনৈতিক সমস্যা আছে, মতভেদ আছে। ব্যালটে নির্বাচন করে সিসিটিভি ব্যবহার করা উচিত।
বৈঠকে বলা হয়, সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্নের জন্য নির্বাচন কমিশনকে কঠোর হতে হবে। কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তাদের কনফিডেন্স বাড়াতে হবে। কমিশনের অনেক দক্ষ জনবল আছে, তাদের দিয়ে আগামী নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ দিতে হবে। প্রয়োজনে কিছু আসনে জেলা প্রশাসক এবং কিছু আসনে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের ভাগ করে দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। জনবলকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে। একই দিনে নির্বাচন করা সম্ভব নয়, ভিন্ন ভিন্ন দিনেই নির্বাচন করতে হবে। একই দিনে নির্বাচন হলে সব ভোটকেন্দ্রে সিসিটিভি ব্যবহার সম্ভব হবে কি না, ভেবে দেখতে হবে।
সাবেকরা বলেন, মাঠের সমন্বয় না থাকলে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। সিস্টেমের পেছনে থাকাদের ব্যাড ইনটেনশন থাকলে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। বর্তমান সময়টা নির্বাচন কমিশনের জন্য দুঃসময়। পেশিশক্তি ও অর্থশক্তি স্বাধীনতার আগে থেকে এখন পর্যন্ত দেশে রয়ে গেছে। এ বাস্তবতাটাকে মেনে নিয়েই কাজ করতে হবে।
বৈঠকে ইসি ও মাঠ প্রশাসনের দূরত্ব ঘুচিয়ে মাঠ প্রশাসনকে পুরোপুরি ইসির নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার কথা বলা হয়েছে। পরামর্শ দেওয়া হয়েছে নির্বাচনে গোলমাল হলে নির্বাচন বন্ধ করার। জানানো হয়েছে ডিসি আর এসপিরা রাজনীতিবিদদের সহযোগী। রাজনৈতিক সরকারের অধীনে নির্বাচনে হাতজোড় করলেও তারা ইসির কথা নয়, সরকারের কথাই শুনবে।
এমকে