প্রয়োগটাই দাঁড়িয়েছে অপপ্রয়োগে

২৩ অক্টোবর ২০২২

বছর দুই  আগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কারাবন্দি লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর পর দেশের লেখক সাংবাদিকদের মধ্যে এ আইন নিয়ে একটা ভয় কাজ করছে। কারণ এ আইনের প্রয়োগটাই অপপ্রয়োগ হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিভিন্ন ধারায় অবারিতভাবেই হয়রানির সুযোগ আছে । ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বিতর্ক শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে মুল প্রবন্ধে এ তথ্য ওঠে এসেছে। এদিকে একই বৈঠকে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছেন, এ আইনের অপব্যবহারের জায়গায় প্লাগিং করার চেষ্টা করছে সরকার। শনিবার (২২ অক্টোবর) রাজধানী ঢাকার বনানীর ঢাকা গ্যালারিতে বৈঠকটি হয়। আয়োজক ছিল এডিটরস গিল্ড বাংলাদেশ।

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে এডিটর্স গিল্ডের যুগ্ম সম্পাদক সাংবাদিক ইশতিয়াক রেজা বলেন,  এ আইন সরকারকে কতটুকু উপকৃত করলো, জনগণ বিশেষ করে সাংবাদিকদের মধ্যে এ আইন নিয়ে কী ধারণা তৈরি হয়েছে- সেটা নিয়ে এখন বিশ্লেষণের প্রয়োজন। বৈঠকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, এ আইনের অপব্যবহার করোনার পর অনেকটাই কমে এসেছে। অনেকাংশেই এখন মামলা আর নেওয়া হয় না। তিনি জানান, এ নিয়ে তার সঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও একমত হয়েছেন- এ আইনে মামলা করার সঙ্গে সঙ্গে সাংবাদিকদের আগেই গ্রেফতার করা হবে না। পাশাপাশি যে কেউ অভিযোগ করলেই সেটাকে আগেই মামলা হিসেবে গ্রহণ করা হবে না। অভিযোগ এ আইনের ধারার মধ্যে পড়ে কি-না, নাকি হয়রানি করা হচ্ছে- এগুলো দেখতে হবে। এ জন্য আইসিটি অ্যাক্টের একটি সেল আছে। সেলটিকে কার্যকর করে  অভিযোগ আমলে নিয়ে এ আইনের কোন ধারার মধ্যে পড়ে কি-না দেখতে হবে। তারপর যখন কোর্টে কিংবা থানায় পাঠানো হবে, তখনই মামলা হিসেবে রুজু করা হবে। তিনি জানান, সাইবার ক্রাইমের ট্রাইব্যুনাল প্রসেকিউশনে  বলে দেওয়া হয়েছে- প্রথমেই যেন ওয়ারেন্ট দেওয়া না হয়। সমন জারি করা কথা বলা আছে, যাতে অভিযুক্ত এসে তার বক্তব্য তুলে ধরতে পারেন।

মানবাধিকার আইনজীবী অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না বলেন, এ আইন হওয়ার পর একে অপরের প্রতি বিদ্বেষ থামার কথা থাকলেও সেটা হয়নি। বরং এ বিচার বিশ্লেষণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে পুলিশের হাতে। অভিযোগ একটা দেওয়া হল- ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে, সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ অ্যারেস্ট করলো। তিনি জানান, এ আইনে জামিন অযোগ্য ১৪টি ধারা আছে। একটি ধারা ঠুকে দিলেই নিম্ন আদালত জামিন দেবে না।

সংস্কৃতিজন নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বলেন,ডিজিটাল মাধ্যমে কুৎসা, নিন্দা এবং হেইট স্পিচে বন্ধে সুরক্ষা থাকার প্রয়োজন আছে। কিন্তু দীপা দেওয়ান ও শরিয়ত বাউলের গ্রেফতারের কারণ শুনলে অবাক হবেন। তারা যা বলেছে, সেটি বিতর্কের খাতিরে বলেছে। তিনি জানান, নাটকে যে কোনও মন্ত্রীর, পুলিশের চরিত্র দেখালে; চলচ্চিত্রে পুলিশের নেতিবাচক চরিত্র দেখানোর কারণে সেগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। এ বিষয়গুলো দিয়ে সৃষ্টিশীল প্রক্রিয়ার স্রোতকে ব্যাহত করা হচ্ছে। সুতরাং কী করা দরকার এ বিষয়ে চিন্তা করতে হবে। এটি খুবই কঠিন একটি সিদ্ধান্তের জায়গা। কারণ জনগণকে সুরক্ষা দিতে হবে, সাংবাদিকদের স্বাধীনতা থাকবে, শিল্পীদের স্বাধীনতা থাকবে। আইনটা প্রয়োগ হবে সমাজ, রাষ্ট্র ও মানুষের অপকারীর ক্ষেত্রে। কিন্তু বাস্তবে সেটা হচ্ছে না বলেও মনে করেন তিনি।   

কবি, সাংবাদিক ও কলামিস্ট সোহরাব হাসান বলেন, আইনের একটা উদ্দেশ্য থাকে-জনগণকে সুরক্ষা। এখন সেই আইন জনগণকে সুরক্ষা না দিয়ে যদি বাক স্বাধীনতা রুদ্ধ করতে চায়, তখন কিন্তু সেটি আর জনগণের আইন থাকে না, জনবিরোধী আইন হয়। তিনি জানান, বিশ্লেষণ করলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যাবে-  রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এ আইন ব্যবহার করা হয়েছে। আরেকটি বিষয় আইন বেশি হওয়ার অর্থ হচ্ছে সরকারের কোথাও না কোথাও দুর্বলতা আছে।

আর্টিকেল-১৯-এর বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ফারুক ফয়সাল বলেন, শুরুতে সরকার কিন্তু এ আইন নিয়ে সমালোচনা খুব একটা শুনতো না। এখন সবখানেই স্বীকার করা হয়েছে,এ আইনের অপব্যবহার হয়েছে। সব মানুষের নির্ভয়ে মত প্রকাশের অধিকার থাকতে হবে, জানার অধিকার থাকতে হবে। কিন্তু একইসঙ্গে এটাও বলি, হেইট স্পিচ ছড়ানো যাবে না। গুজব বা ভুল তথ্য ছড়ানো যাবে না। ফ্যাক্ট চেকের একটা ব্যবস্থা থাকতে হবে।

এমকে

 

 


মন্তব্য
জেলার খবর