হুড খোলা গাড়িতে নিজের ডাকা লংমার্চে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ইমরান খান। চারপাশে সাদা কাপড় বেষ্টিত নেতাকর্মী। আর সবার মাঝে কালো কাপড়ে নিজে। নিশানাবাজের কাজ বেশ সহজ করে দিয়েছিলেন ইমরান নিজেই।
হাজারও লোকের ভিড়ের মধ্যে ইমরান খানকে লক্ষ্য করে একের পর এক গুলি চালাতে থাকেন বন্দুকবাজ। উদ্দেশ্য ছিল ইমরানকে হত্যা করা। কিন্তু সবক’টি গুলিই লাগে পায়ে। বেঁচে যান তিনি। অন্তত চারটি গুলি তার পায়ে লেগেছে বলে জানিয়েছে পাকিস্তানি গণমাধ্যম। হামলাকারীকে আটক করেছে পুলিশ।
জিও টিভির এক প্রশ্নের জবাবে ওই হামলাকারী জানান, ইমরান খান জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। এ কারণেই কেবল তাকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন ওই হামলাকারী। তবে ইমরান খানের পায়ে গুলি লাগলেও বর্তামনে অনেকটাই আশঙ্কামুক্ত। তবে সুস্থ হতে এখনও সময় লাগবে।
ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)-কে ক্ষমতাচ্যুত করার পরে ইমরানের দাবি করেছিলেন, ওই সিদ্ধান্ত অবৈধ। নির্বাচনে জিতে ফের ক্ষমতায় আসতে তখন থেকেই রাস্তায় নামেন তিনি। এটা ছিল তার দ্বিতীয় লং মার্চ। দুই লং মার্চেই অেকজনের অংশগ্রহণ ছিল নজরকাড়া। কিন্তু এ জনপ্রিয়তা কি সঙ্ঘবদ্ধ দুই প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তান মুসলিম লিগ (পিএমএল) ও পাকিস্তান পিপল্স পার্টি (পিপিপি)-কে পরাজিত করে ইমরানকে আবার পাকিস্তানের তখ্তে ফেরাতে পারবে? এ প্রশ্ন যখন লাহোর, মুলতান, করাচি, রাওয়ালপিন্ডির অলিন্দে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, ঠিক সেই সময়েই আততায়ীর চারটি বুলেট বিঁধে গেল তার শরীরে।
বস্তুত ভারতের এক দিন আগে স্বাধীনতা অর্জন করলেও পাকিস্তানের গণতন্ত্র বিকশিত হয়নি এ ৭৫ বছরেও। কূটনীতিকেরা বলেন, আসলে এক পাকিস্তানের মধ্যে বসত করে অনেক পাকিস্তান। অন্তত ৪টি ভরকেন্দ্র পাকিস্তানের, যার কোনওটিই নির্বাচিত সরকারের হাতে নিরঙ্কুশ শাসন ক্ষমতা তুলে দেয় না। উর্দিধারীরাই পাকিস্তানের আসল নিয়ন্ত্রক। আবার বাহিনীতেও সেনাপ্রধানের সঙ্গে ক্ষমতার টক্কর বাধে আর এক শক্তিশালী কেন্দ্র, গুপ্তচর সংস্থা আইএসএই-এর কর্তাদের। আছে মৌলবাদী জঙ্গি শক্তি, যাদের চটিয়েও তখ্ত উপভোগ অসম্ভব সে দেশে। আর রয়েছে এমন এক বিচার ব্যবস্থা, ক্ষমতার আস্ফালনই যার রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অনেকে বলে থাকেন, ইমরান খান যে নিজের কব্জির জোরে পিপিপি এবং পিএমএল-এর উইকেট ছিটকে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন— ব্যাপারটা আদৌ তেমন নয়। আসলে পাকিস্তানের ক্ষমতার আসল নিয়ন্ত্রকেরা তাকে চেয়েছিলেন, তারাই তাকে ক্ষমতায়ও বসিয়েছিলেন। ইমরানই প্রথম কোনো অসামরিক ব্যক্তি, যিনি শরিফ ও ভুট্টো পরিবারের সমর্থন ছাড়া পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। আইএসআই-এর প্রধান হিসেবে নিজের পছন্দের লোককে বাছাই করে সেনাপ্রধান জেনারেল কমর বাজওয়াকে চটিয়ে ফেললেন ইমরান। রাতারাতি জেনারেল ঘোষণা করলেন— সরকার নিয়ন্ত্রণে তিনি কোনো দিন এগোননি, পিটিআই সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করতে তিনি চানও না।
ইশারা বুঝে গেলেন সমঝদারেরা। ৭৫ বছরের রক্তক্ষয়ী ঝগড়া তুলে রেখে শরিক হয়ে গেল পিপিপি ও পিএমএল। বিচারপতিরা তৎপর হয়ে উঠলেন সরকার ফেলতে। অনভিজ্ঞ ইমরান ভুল চাল চেলে ফেললেন ভারতের প্রশংসা এবং আমেরিকার কড়া সমালোচনা করে। এরপর বেশি দিন তার ক্ষমতায় থাকার কথা নয়, থাকেননিও।
কিন্তু ইমরানের দ্বিতীয় দফার লড়াইয়ে যেন পাকিস্তানে সত্যিকারের গণতন্ত্র স্থাপনের সুর খুঁজে পাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। দুই আমল মিলিয়ে দেখে তারা ইমরানের পিটিআই সরকারকেই বেশি নম্বর দিয়ে ফেলছেন। এমন অবস্থায় ইমরানের নিশানা হওয়াটা সময়ের অপেক্ষা ছিল। তবে সন্দেহ নেই এ হামলা ইমরানের জনপ্রিয়তা বাড়াবে। তিনি নিজেও তা বুঝেছেন বইকি। পায়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দ্রুত ফিরে এসেছেন এ বার্তা দিতে, যে ময়দান ছেড়ে পালানোর মানুষ নন। শিগগিরই ফিরবেন দর্পের সাথে।