পুতিনের হয়ে ইউক্রেনের বিপক্ষে ভাড়াটে যোদ্ধা হিসেবে যুদ্ধ করছিল ওয়াগনার
গ্রুপ। সম্প্রতি ওয়াগনার গ্রুপের প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোজিন বিমান বিধ্বস্ত হয়ে নিহত
হন। তার মৃত্যুর কয়েকদিন পার হলেও বিধ্বস্তের কারণ এখনো পরিষ্কার হয়নি।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে বড় চ্যলেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়ার
মাত্র দুই মাসের মাথায় বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় প্রিগোজিন নিহত হন। এ বিষয়টি রাশিয়ার
ভেতরে এবং বাইরে নানা সন্দেহ তৈরি হয়েছে।
প্রিগোজিনের মৃত্যুকে স্বাভাবিক মৃত্যু মানতে নারাজ যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স
ও যুক্তরাজ্য। তারা যেসব ইঙ্গিত মূলক কথা-বার্তা বলছেন তার অর্থ হচ্ছে- এ বিমান বিধ্বস্তের
ঘটনা যে মস্কোর দ্বারা সাজানো তা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
প্রিগোজিনের নিহত হওয়াকে অপ্রত্যাশিত বলা যায় না। বিশেষ করে পুতিন ক্ষমতায়
আসার পর থেকে তার অন্তত বিশজন প্রতিপক্ষ, সমালোচক বা ‘বিশ্বাসঘাতক’ খুব অদ্ভুত উপায়ে
রাশিয়া অথবা রাশিয়ার বাইরে মারা গেছেন।
১৯৯৯ সালে সেপ্টেম্বরে অ্যাপার্টমেন্ট ভবনে যে হামলা হয় তার তদন্তে গঠিত
সংসদীয় কমিটির প্রধান ছিলেন ইউশেঙ্কোভ। ইউশেঙ্কোভকে গুলি করা হয় মস্কোর রাস্তায়।
মস্কো এ হামলার জন্য চেচেন সন্ত্রাসীদের দায়ী করে।
২০০৬ সালের ৭ই অক্টোবর আন্তর্জাতিকভাবে অন্যতম ঘৃণিত একটা অপরাধ ঘটে। সাংবাদিক
আনা পোলিতকোভস্কায়ার হত্যা। যিনি রাশিয়ান সংবাদমাধ্যম নোভায়া গ্যাজেটায় চেচনিয়ায়
ক্রেমলিন বাহিনীর দ্বারা সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার নিন্দা জানান।
যদিও ২০১৪ সালে এই অপরাধে পাঁচজন কথিত লেখককে দীর্ঘ কারাবাসে পাঠানো হয়,
কিন্তু কর্তৃপক্ষ কখনোই শনাক্ত করতে পারেনি যে খুনিদের কে ভাড়া করেছিল এবং ২০২১ সালে
এ নিয়ে মামলা দায়ের হয়।
২০১৫ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারি আরেকটি হত্যাকান্ডে সন্দেহ আরও জোরালো হয়
যে ক্রেমলিন কৌশলে তার প্রতিপক্ষদের সরিয়ে দেয়। সেদিন সাবেক ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার
বরিস নেমেতসভ খুন হন। যে জায়গাটিতে তাকে হত্যা করা হয় সেটি পুতিনের অফিস ভবনের খুব
কাছে।
নব্বই দশকের শেষ দিকে নেমেতসভ ছিলেন রাশিয়ার রাজনীতিতে এক উঠতি তারকা। এ
উদারমনা বিজ্ঞানী ও রাজনীতিবিদকে ভাবা হচ্ছিল সে সময়ের প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলতসিনের
পরবর্তী উত্তরসূরী, কিন্তু যিনি পরবর্তীতে সাবেক গুপ্তচরকেই বেছে নেন।
একদম প্রায় শুরু থেকেই এই নিখোঁজ রাজনীতিবিদ পুতিনের কড়া সমালোচনা শুরু
করেন, বিশেষ করে তার ইউক্রেন নীতি এবং নিজের ক্ষমতা চিরস্থায়ী করে রাখার মনোভাবের
জন্য। তার এই অবস্থান তাকে অন্তত তিনবার কারাগারে নেয়।
২০০৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় তিনি পুতিনের বিরুদ্ধে নির্বাচনের
চেষ্টা করেও সরে আসেন। কিন্তু এর এক বছর পর তিনি তার অন্যান্য সব পুতিন বিরোধীদের
নিয়ে সলিডারিটি পার্টি নামে নতুন রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন, যাদের মধ্যে ছিলেন দাবার
সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন গ্যারি কাসপারভও।
নেমেতসভের হত্যাকারীরা চেচেন বাহিনীর নেতৃত্বের একটা অংশ রাদমান কাদিরভের
অনুসারী হলেও, এই অপরাধের সাথে পুতিনের মিত্র হিসেবে স্বীকৃত কাদিরভের সংশ্লিষ্টতা
কখনোই তদন্ত করা হয়নি।
২০০০ সালের পর আরো ছয় জন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী যারা
পুতিনের সমালোচনা করেছেন রাশিয়ায় তাদের হত্যা করা হয়।
তবে প্রতিপক্ষ ও সমালোচকদের মারা যাওয়ার এই তালিকা শুধুমাত্র রাশিয়াতেই
সীমাবদ্ধ নয়। যারা চলে গিয়েছিলেন এই ভেবে যে রাশিয়ার বাইরে গেলে তারা নিরাপদ এমন অনেকেও
আছেন।
এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত নাম সাবেক গুপ্তচর আলেক্সান্ডার লিতভিনেঙ্কো,
যিনি ২০০৬ সালে নভেম্বরে হঠাৎ অসুস্থ বোধ করে লন্ডন হাসপাতালে মারা যান। পরে এক তদন্তে
জানা যায় সাবেক এ গুপ্তচর পলোনিয়াম ২১০ এর বিষক্রিয়ায় মারা গিয়েছেন, যা খুবই উচ্চমাত্রার
একটা রেডিওঅ্যাকটিভ পদার্থ।
লিতভিনেঙ্কো এই শতকের শুরুর দিকে যুক্তরাজ্যে আশ্রয় নেন, যখন তিনি জানান
যে তার উর্ধ্বতন তাকে অলিগার্ক বরিস বেরেজোভস্কিকে হত্যার আদেশ দিয়েছে।
বেরেজোভস্কি হলেন দেশের বাইরে প্রাণ হারানোদের আরেকজন। ২০১৩ সালের মার্চে
এই ব্যবসায়ীর মৃতদেহ পাওয়া যায় ইংল্যান্ডের দক্ষিণপূর্বে তার নিজ বাড়ি সারেতে।
কেউ কেউ বলে থাকেন যে আর্থিক দেনার কারণে এই অলিগার্ক আত্মহত্যা করেছিলেন।
কিন্তু তার নির্বাসনের সময়টায় তার উপর অনেকগুলো হামলা হয় এবং মস্কোর দ্বারা একটানা
বিচারিক প্রহসনের স্বীকার হওয়ার কারণে কারো কারো ধারণা তাকে হত্যা করা হয়েছে।
বেরেজোভস্কি ইয়েলেতসিনের শাসনামলে অঢেল সম্পদ অর্জন করেন, পরে তিনি পুতিনের
সাথেও সখ্য গড়ে তোলেন এবং তার প্রথমবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তহবিল যোগান তিনি।
তবে মতবিরোধ দেখা দেয় যখন ক্রেমলিন তার মালিকানাধীন টিভি চ্যানেল বাজেয়াপ্ত করে।
২০১৮ সালের মার্চে যুক্তরাজ্যে নির্বাসনে থাকা ভিন্নমতাবলম্বী আরেক রাশিয়ান
মস্কোর দ্বারা হামলার শিকার হন বলে অভিযোগ ওঠে। সাবেক গুপ্তচর সের্গেই স্ক্রিপাল
এবং তার মেয়ে ইউলিয়াকে এক রাশিয়ান এজেন্ট ইংলিশ শহর সালিসবুরিতে নভিচক বিষ প্রয়োগ
করেন বলে জানা যায়।
স্ক্রিপাল রাশিয়ার সেন্ট্রাল ইন্টিলিজেন্স ডিপার্টমেন্ট (জিআরইউ) এর হয়ে
কাজ করেন, একই সাথে তিনি ছিলেন ব্রিটেনের গুপ্তচর সংস্থা এমআইসিক্সের ডাবল এজেন্ট।
২০০৪ সালে রাশিয়ায় গ্রেফতার হন তিনি। তাকে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে ১৩ বছরের সাজা দেয়
রাশিয়ান আদালত, কিন্তু পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রে আটক তাদের কিছু এজেন্টের সাথে স্ক্রিপালকে
বিনিময় করে মস্কো।
এই হামলার পেছনে লন্ডন রাশিয়ান ইন্টিলিজেন্সের দুজন সদস্যকে শনাক্ত করে
এবং মস্কোকে তাদের হস্তান্তর করতে বলে।
কিন্তু রাশিয়ার সরকার এর সাথে কোন ধরণের যোগাযোগ অস্বীকার করে এবং লন্ডনের
অনুরোধ নাকচ করে দেয়। যে সূত্র ধরে রাশিয়ার ইউক্রেন অভিযানের আগে থেকেই তাদের সাথে
যুক্তরাজ্যের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছিল।
এই তালিকায় নিশ্চিতভাবেই আরো অন্তত ছয় জন আলিগার্ক ও সাবেক রাশিয়ান কর্মকর্তার
নাম যোগ হবে, যারা ইউক্রেনে অভিযান শুরুর পর রহস্যজনকভাবে মারা গিয়েছে।
এর মধ্যে সবচেয়ে সাড়া জাগানো মৃত্যু হলো রাশিয়ায় তেলের জায়ান্ট লুকোইলের
প্রেসিডেন্ট রাভিল ম্যাগানভ। তিনি গত বছরের সেপ্টেম্বরে মস্কোয় যে হাসপাতালে ভর্তি
ছিলেন সেখানে ‘জানালা দিয়ে পড়ে’ মারা যান, কর্তৃপক্ষ এমনটাই জানিয়েছে।
আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা মনে করেন রাশিয়ান প্রেসিডেন্টের এই পদ্ধতি
‘খুবই কার্যকর’, কারণ এটা তাকে তার ‘বিরোধীদের যেমন থামিয়ে দেয়’ তেমনি ‘অভ্যন্তরীণ
যে কোনো চ্যালেঞ্জ’ তাকে পার করে দেয়।
সূত্র: বিবিসি