মাতৃদুগ্ধদানকারী মায়েদের নিয়ে আমাদের সমাজে কিছু ভ্রান্ত ধারণা আছে। ইউনিসেফ
সেসব ধারণা ভাঙতে বিশেষজ্ঞদের মতামত জানিয়ে সহায়তা করে থাকে। ভুল বা ভ্রান্ত ধারণাগুলো
হলো-
১. ভুল ধারণা? শিশুকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো সহজ।
অনেকেরই ধারণা শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো খুব সহজ। এটি অতি প্রাকৃতিক ও শিশুর
সহজতা প্রবৃত্তি হলেও শিশুকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়াতে প্রয়োজন উপযোগী পরিবেশ, মায়ের
সুস্বাস্থ্য, পরিচর্যা ও অনুশীলন। খুঁজে নেওয়ার প্রবৃত্তি নিয়েই শিশুরা জন্মায়। শিশুকে
মায়ের বুকের দুধ সময় নিয়ে খাওয়াতে হয়। তাই মা ও শিশু দু’জনেরই অনুশীলন দরকার
হয়। সে কারণে বাড়ি ও কাজের উভয় জায়গাতেই সন্তানকে মায়ের দুধ খাওয়ানোর জন্য উপযুক্ত
ব্যবস্থা ও সহযোগিতার প্রয়োজন হয়।
২. ভুল ধারণা? বুকের দুধ খাওয়াতে গেলে আঘাত লাগবেই
বুকের দুধ খাওয়াতে গেলে আঘাত লাগবেই ব্যপারটা এমন নয়। তবে স্তনের বোঁটায়
ক্ষত দেখা দিলে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে। কোনো মা এ ধরনের সমস্যায় পড়লে স্তনদান বিষয়ক
বিশেষজ্ঞ বা দক্ষ পেশাজীবীর পরামর্শ নিয়ে তা কাটিয়ে উঠতে পারেন। অথবা ক্ষত থাকাকালীন
সময়ে নিপল শিল্ড ব্যবহার করে শিশুকে দুধ পান করাতে পারেন।
৩. ভুল ধারণা? শিশুকে দুধ খাওয়ানোর আগে স্তনের বোঁটা ধুয়ে নিতে হবে।
শিশুকে বুধের দুধ খাওয়ানোর আগে স্তনের বোঁটা ধুয়ে নেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।
শিশুরা জন্মের পর থেকেই তার মায়ের শরীরের গন্ধ ও কন্ঠস্বরের সঙ্গে পরিচিত থাকে। তাছাড়া
স্তনের বোঁটায় কিছু পদার্থ তৈরি হয় যার ঘ্রাণ শিশুরা চিনতে পারে এবং তাতে এক ধরনের
ভালো ব্যাকটেরিয়াও থাকে। যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
৪. ভুল ধারণা? মায়ের বিশ্রামের জন্য শিশু ও তার মাকে আলাদা রাখতে হয়
ডাক্তার, নার্স ও ধাত্রীরা প্রায়ই জন্মের পরপরই শিশুকে তার মায়ের সংস্পর্শে
রাখতে বলেন। একে ‘ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার’ও বলা হয়। এভাবে মায়ের সংস্পর্শে রাখা, গায়ের
সঙ্গে লেগে থাকা শিশুদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যা তাদের মায়ের বুকের দুধ খুঁজতে ও পেতে
সহায়তা করে। যদি শিশুর জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে তা করা যায় এবং এরপরে বারবার তা করা
যায়, তাহলে শিশুরা সহজে দুধ পাবে। যদি মা তা একা না করতে পারেন, তাহলে পরিবারের অন্যান্য
সদস্যদের মা ও শিশুকে সাহায্য করতে হবে।
৫. ভুল ধারণা? শিশুকে দুধ খাওয়ানোর দিনগুলোতেই মাকে শুধু সাধারণ খাবে
অন্য সবার মতোই নবজাতকের মাকেও সুষম খাবার খেতে হবে। সাধারণত খাদ্যাভ্যাস
বদলানোর কোনো দরকার নেই। তবে বাড়তি খাবার গ্রহণ জরুরি। এসময় মাকে নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার
গ্রহণ করতে হবে।
৬. ভুল ধারণা? ব্যায়াম দুধের স্বাদ পাল্টে ফেলবে।
এ ধারণাটি একেবারেই ভুল। ব্যায়াম শরীরের জন্য উপকারী। স্তনদানকারী মায়েদের
ক্ষেত্রেও তা একইভাবে সত্যি। ব্যায়াম করলে দুধের স্বাদ পাল্টে যায় না।
৭. ভুল ধারণা? আপনি যদি জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই দুধ না খাওয়ান পরে আর পারবেন
না।
শিশুর জন্মের পর এক ঘণ্টার মধ্যে বুকের দুধ খাওয়ানো শুরু করাটা সহজ। কারণ
এই সময়ে শিশুরা বুকের দুধের প্রতি বেশি আগ্রহী থাকে। কীভাবে মায়ের বুকের দুধ খেতে হবে
তা শেখার জন্য সে এসময় প্রস্তুত থাকে। যদি জন্মের পরপরই শিশুকে দুধ খাওয়াতে না পারেন,
তাহলে পরে আপনার অবস্থা অনুযায়ী যত দ্রুত সম্ভব খাওয়ানো যায়। তবে জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই
দুধ না খাওয়ালে পরে আর পাবে না ব্যাপারটা এমন নয়।
৮. ভুল ধারণা? বুকের দুধ খাওয়াতে চাইলে কখনোই ফর্মুলা (বাজারে যেসব দুধ
পাওয়া যায়) দেওয়া যাবে না।
মায়ের জটিল শারীরিক অক্ষমতায় বা হরমোনাল সমস্যায় বুকে দুধ আসতে বিলম্ব করলে
শিশিকে ফর্মুলা মিল্ক দেওয়া যেতে পারে। আবার বুকের দুধ খাওয়ানোর পাশাপাশি মায়েরা শিশুদের
কখনো কখনো ফর্মুলা খাওয়ানোর কথা ভাবতে পারেন। সেক্ষেত্রে শিশুর ফর্মুলা বা সম্পূরক
খাবারের বিষয়ে সঠিক তথ্য থাকতে হবে। বুকের দুধ তৈরি অব্যহত রাখার জন্য যত বেশিবার সম্ভব
শিশুকে বুকের দুধ দিতে হবে।
৯. ভুল ধারণা? অনেক মায়েরই শরীরে পর্যাপ্ত মাতৃদুগ্ধ থাকে না।
প্রায় সব মায়ের শরীরে তার শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় মাতৃদুগ্ধ তৈরি হয়। শিশুকে
কতখানি সঠিকভাবে মায়ের বুকে সাথে সংযুক্ত করা হচ্ছে, কত ঘন ঘন দুধ খাওয়ানো হচ্ছে এবং
শিশুটি প্রতিবার কত ভালোভাবে মায়ের বুকের দুধ টানছে তার ওপর মাতৃদুগ্ধ তৈরি হওয়ার বিষয়টি
নির্ভর করে। এ সময় সহযোগিতা এবং যথেষ্ট পরিমাণে পুষ্টিকর খাবার ও পানীয় (পানিসহ) পানের
মাধ্যমে মাকে সুস্থ থাকতে হবে।
১০. ভুল ধারণা? অসুস্থ মায়েরা দুধ খাওয়াতে পারবেন না।
এটা নির্ভর করবে অসুস্থতার ধরনের ওপর। তবে মায়েরা সাধারণত অসু্স্থতায় শিশুকে
বুকের দুধ খাওয়ানো চালিয়ে যেতে পারবেন। শুধু সেক্ষেত্রে মায়ের চিকিৎসা,পর্যাপ্ত বিশ্রাম
ও যথাযথ খাবার নিশ্চিত করতে হবে। মায়ের দুধের মাধ্যমে শিশুর শরীরে জীবাণু নয় বরং রোগ
প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন উপাদান যায়। অনেক ক্ষেত্রে মায়ের শরীরে যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা
সক্রিয় থাকে, তা দুধ খাওয়ানোর মধ্য দিয়ে শিশুর শরীরেও সঞ্চারিত হয়। যা শিশুর জন্যও
ভালো। যা তার শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরিতে সহায়তা করে।
১১. ভুল ধারণা? দুধ খাওয়ানোর সময় ওষুধ সেবন করা যায় না।
যে ওষুধগুলো বুকের দুধ খাওয়ানো অবস্থাও দেওয়া সম্ভব সেগুলো সেবনের পাশাপাশি
শিশুকে দুধ দিতে কোনো সমস্যা নেই। তবে এ সময় চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ সেবন করতে হবে।
ওষুধ সেবনের আগে সে বিষয়ে শিশুর চিকিৎসককেও জানাতে হবে।
১২. ভুল ধারণা? বুকের দুধ খাওয়া শিশুরা মায়ের সাথে আঁকড়ে থাকে।
সব শিশুই আলাদা। কেউ কেউ বেশি আঁকড়ে থাকে, কেউ কেউ থাকে না। তবে এর সঙ্গে
তাদের মায়ের বুকের দুধ পানের কোনো সম্পর্ক নেই।
১৩. ভুল ধারণা? এক বছরের বেশি পার হলে শিশুদের দুধ ছাড়ানো যায় না।
এমন কোনো প্রমাণ নেই যে, এক বছরের বেশি বয়সের শিশুদের মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো
বন্ধ করা যায় না। তবে এটি প্রমাণিত যে, দুই বছর পর্যন্ত দুধ খাওয়ানো শিশু ও তার মা
উভয়ের জন্যই মঙ্গলজনক।
১৪. ভুল ধারণা? কাজে ফিরলে শিশুকে দুধ খাওয়ানো বন্ধ করতে হবে।
অনেক মা-ই কাজে যোগদানের পরও শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ান। সেক্ষেত্রে প্রথমে
দেখতে হবে আপনি যেখানে কাজ করেন সেখানকার নিয়ম-কানুন কেমন। অফিসে কাজের মাঝখানে যদি
শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর যথেষ্ট সময় ও সুযোগ থাকে, তাহলে হয়তো আপনি বাসায় গিয়ে শিশুকে
দুধ খাইয়ে আসতে পারেন। অথবা পরিবারে কাউকে বা বন্ধুদের সাহায্যে শিশুটিকে ওই সময় আপনার
কর্মস্থলে নিয়ে আসতে পারেন অথবা বুকের দুধ বোতলে সংগ্রহ করে রাখতে পারেন।