শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর রাষ্ট্র পরিচালনায় দায়িত্ব নিয়েছেন নোবলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। দায়িত্ব নেওয়ার ১৫ দিনের মাথায় রোববার (২৫ আগস্ট) জাতির উদ্দেশে প্রথম ভাষণ দিয়েছেন ড. ইউনূস। তিনি বলেছেন- নির্বাচন কখন হবে, সেটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, আমাদের সিদ্ধান্ত নয়।

প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ সরকারি টেলিভিশন সরাসরি সম্প্রচার করে। সরকারের পক্ষ থেকে আপনাদের দোয়া ও সহযোগিতা কামনা করতে আপনাদের সামনে এসেছি- ভাষণে উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন-  আমরা ছাত্রদের আহ্বানে এসেছি, তারা আমাদের প্রাথমিক নিয়োগকর্তা। আমাদের নিয়োগ দেশের আপামর জনসাধারণ সমর্থন করেছে। ক্রমাগতভাবে সবাইকে আমরা বিষয়টি স্মরণ করিয়ে যাব যাতে এ প্রশ্ন উত্থাপিত না হয়—আমরা কখন যাব। তারা যখন বলবে আমরা চলে যাব।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জনপ্রত্যাশা পূরণে বদ্ধপরিকর বলে জানান প্রধান উপদেষ্টা। বলেন, যে স্বপ্ন নিয়ে ছাত্র-জনতা স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল, সেই স্বপ্ন পূরণে তিনি ও তার সরকার অঙ্গীকারাবদ্ধ।

তিনি বলেন, গণরোষের মুখে ফ্যাসিবাদী সরকার দেশ ত্যাগের পর এমন একটি দেশ গড়তে চাই আমরা, যেখানে প্রত্যেক নাগরিকের মানবাধিকার পুরোপুরি সুরক্ষিত  থাকবে। উদার, গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়াই সরকারের লক্ষ্য।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা এক পরিবার, আমাদের এক লক্ষ্য। কোনো ভেদাভেদ যেন আমাদের স্বপ্নকে ব্যাহত করতে না পারে, সেজন্য আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

ফ্যাসিবাদী সরকারের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, খুন, অপহরণ এবং আয়নাঘরের মতো চরম ঘৃণ্য সব অপকর্মের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে বলেও তার ভাষণে উল্লেখ করেন ড. ইউনুস। বলেন, বিচার বিভাগকে দুর্নীতি ও দলীয় প্রভাবমুক্ত করতে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। একটি সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তালিকা প্রস্তুত করে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করা হবে। দুর্নীতি ও সম্পদ পাচারের বিচার করা হবে।

তিনি বলেন, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের পরিবারকে পুনর্বাসন করা হবে। আহত সব শিক্ষার্থী ও জনতার চিকিৎসার ব্যয় সম্পূর্ণ বহন করবে সরকার।

ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচারের হাতে দেশের সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়েছে বলে জানান প্রধান উপদেষ্টা। এতদিন দেশে যেভাবে দুর্নীতি হয়েছে, সেটার উদাহরণ দিতে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পিওনের ৪০০ কোটি টাকার মালিক হওয়ার বিষয়টি সামনে আনেন  তিনি। বলেন, দেশের মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে স্বৈরাচার তার নিজের, পরিবারের ও দলের কিছু মানুষের স্বার্থ হাসিলের পথ তৈরি করে দিয়েছে।  পঙ্গু করে দিয়েছে শিক্ষা খাত। লুটপাট হয়েছে  ব্যাংকিং ও শেয়ারবাজার খাতে, প্রকল্প ব্যয়ে বিশ্বরেকর্ড, অবাধ সম্পদ পাচার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাকে নিজ দলের পুতুলে রূপান্তর, বাকস্বাধীনতা ও মানবাধিকার হরণ—এসবই হিমশৈলের অগ্রভাগ মাত্র। শুধু তাই নয়, ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে ফ্যাসিবাদী সরকার জনগেণর সাংবিধানিক ক্ষমতা ও অধিকার  খর্ব করেছে। দুঃশাসন, দুর্নীতি, অন্যায়-অবিচার নিপীড়ন, বিচারের নামে প্রহসনের মাধ্যম জনসুরক্ষা বিপন্ন করেছে। বছরের পর বছর নতুন প্রজন্মসহ কোটি কোটি মানুষের ভোটাধিকারকে হরণ করেছে।

দেশের আর্থিক খাত ও শেয়ারবাজারে লুটপাট এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার সরকারের কঠোর অবস্থানের কথা উল্লেখ করে দায়িত্ব পালনে সবার সহযোগিতা কামনা করেন  ড. ইউনুস।

সাম্প্রতিক ভয়াবহ বন্যায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেওয়া বিভিন্ন কার্যক্রম তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টা। বলেন, বন্যা কবলিত এলাকার মানুষের দূর্ভোগ লাঘবে সরকারের যত কার্যক্রম আছে সেটা সচল করা হয়েছে। বন্যাপরবর্তী কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে, ভবিষ্যতে বন্যা নিয়ন্ত্রণে করণীয় পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করার মাত্র দুই সপ্তাহ শেষ হয়েছে জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা অনুধাবন করছি- আমাদের কাছে আপনাদের প্রত্যাশা অনেক। এ প্রত্যাশা পূরণে বদ্ধপরিকর আমরা।

দীর্ঘদিনের গণতন্ত্রহীনতা, ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থা রাষ্ট্রের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই পর্বতসম চ্যালেঞ্জ রেখে গেছে উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণে আমরা প্রস্তুত।  শুধু বলব, আপনাদের একটু ধৈর্য ধরতে হবে।

দাবি পূরণের জন্য জোর করা, প্রতিষ্ঠানে ঢুকে ব্যক্তিবিশেষকে হুমকির মধ্যে ফেলা, মামলা গ্রহণের জন্য চাপ সৃষ্টি করা, বিচারের জন্য গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে আদালতে হামলা করে আগেই একধরনের বিচার করে ফেলার প্রবণতা থেকে বের হয়ে আসার আহ্বান জানান প্রধান উপদেষ্টা। বলেন, এসব কাজে ছাত্র-জনতার বিপ্লবের গৌরব ও সম্ভাবনা  ম্লান হয়ে যাবে, নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রচেষ্টাও ব্যাহত হবে।

বিডি২৪অনলাইন/এন/এমকে