গত অর্থবছরে (২০২৩-২৪) সরকারের টিআর কর্মসূচির আওতায় দ্বিতীয় কিস্তিতে বরাদ্দকৃত অর্থ বাস্তবায়নের জন্য পাবনার চাটমোহর উপজেলায় ৫টি প্রকল্প অনুমোদন হয়। এর মধ্যে দুটি প্রকল্পের অবস্থানগত অস্তিত্ব নিয়ে সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রশ্ন উঠেছে।
প্রকল্প দুটির মধ্যে একটির প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটিতে যে ৫ জনের নাম রয়েছে, তাদের একজন জানিয়েছেন (ভিডিও সংরক্ষিত)- প্রকল্প দেওয়া যে প্রতিষ্ঠানের প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটিতে তার নাম আছে, সেই প্রতিষ্ঠানের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে জানেন না তিনি। ২০ বছর আগে প্রতিষ্ঠানটি থেকে বই নিয়ে পড়েছেন, কিন্তু তারপর এ সম্পর্কে কিছু জানেন না তিনি।
অবস্থানগত অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠা প্রকল্প দুটি হচ্ছে- ‘চাটমোহর বড়াল পাঠাগার উন্নয়ন’ এবং ‘মুক্তিযোদ্ধের শহীদ স্মৃতি পাঠাগার উন্নয়ন’। দ্বিতীয় কিস্তিতে বাকি তিন প্রকল্প হচ্ছে- বারোয়ারী শ্রীশ্রী দূর্গামাতা বিগ্রহ মন্দির উন্নয়ন,চরনবীন পূর্বপাড়া জামে মসজিদ উন্নয়ন ও চাটমোহর থানার গাড়ী গ্যারেজ নির্মাণ।
প্রকল্প সংক্রান্ত নথির তথ্য বলছে, চাটমোহর বড়াল পাঠাগারের উন্নয়ন বাবদ বরাদ্দ ৫০ হাজার টাকা এবং ‘মুক্তিযোদ্ধের শহীদ স্মৃতি পাঠাগার উন্নয়নে বরাদ্দ ৩ লাখ টাকা। প্রকল্প দুটির বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি রকিবুর রহমান টুকুন। ‘মুক্তিযোদ্ধের শহীদ স্মৃতি পাঠাগার উন্নয়ন’ বাস্তবাস্তবায়ন কমিটির সাধারণ সম্পাদক হলেন মেহেদী হাসান। আর চাটমোহর বড়াল পাঠাগার উন্নয়ন’ বাস্তবায়ন কমিটিতে সদস্য সচিব হেলালুর রহমান জুয়েল। এ দুটি প্রকল্পের প্রতিটির বাস্তবায়ন কমিটিতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক/সদস্য সচিবসহ মোট সদস্য ছিলেন ৫ জন।
একাধিক সূত্র বলছে, প্রকল্প দুটির বাস্তবায়ন কমিটিতে যারা ছিলেন, তাদের মধ্যে ৬ জন স্থানীয়ভাবে সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত, এর মধ্যে একজন আবার উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সদস্যও। দুই জন ছিলেন উভয় কমিটিতে। এ ৬ জনের মধ্যে কেউ কার্যনির্বাহী কমিটিতে আর কেউ সদস্য হিসেবে চাটমোহর প্রেসক্লাব’র সঙ্গে সম্পৃক্ত।
এ দুটি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি গঠনের প্রস্তাব সংক্রান্ত নথি অনুযায়ী, ‘মুক্তিযোদ্ধের শহীদ স্মৃতি পাঠাগার উন্নয়ন’ প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির ক্ষেত্রে সুপারিশ করেন তৎকালীন চাটমোহর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এস এম নজরুল ইসলাম, নথিতে সাক্ষর রয়েছে পাবনা-৩ আসনের তৎকালীন এমপি মকবুল হোসেনের। ‘অনুমোদন করা যাইতে পারে’- তার নিচে সাক্ষর রয়েছে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা এস এম শামীম এহসানের, ‘অনুমোদন করা হলো’- তার নিচে সাক্ষর রয়েছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তী রেদুয়ানুল হালিমের। আর চাটমোহর বড়াল পাঠাগার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির ক্ষেত্রে একইভাবে সাক্ষর রয়েছে সাবেক এমপি মকবুল হোসেনের, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা এস এম শামীম এহসান ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তী রেদুয়ানুল হালিমের।
বিভিন্ন সূত্র জানা গেছে, প্রকল্প দুটি গত অর্থবছরের হলেও অস্তিত্বের বিষয়টি সামনে আসে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর। স্থানীয় সামাজিক সংগঠন চাটমোহর যুব সোসাইটির সভাপতি শেখ জাবের আল শিহাব ফেসবুকে বিষয়টি সামনে নিয়ে আসেন। গত ১৬ অক্টোবর নিজের আইডিতে এ নিয়ে একটি পোস্ট দেন তিনি। মুলত, এরপরই অনলাইন-অফলাইনে শুরু হয় প্রকল্প দুটি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা। প্রকল্পের বিষয়টি তুলে ধরে পোস্টে শিহাব উল্লেখ করেন- চাটমোহর বড়াল পাঠাগার নামে কোনো পাঠাগারের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। মুক্তিযুদ্ধের শহীদ স্মৃতি পাঠাগারের অস্তিত্ব অতীতে থাকলেও কয়েক বছর যাবৎ পাঠাগারটির কোন অস্তিত্ব নেই।
সরকারের টাকা বছরের পর বছর এভাবেই একটি কুচক্রি মহল আত্মসাৎ করে আসছে বলেও পোস্টে উল্লেখ করেন সমাজ সচেতন এ তরুণ। সেখানে তিনি আরও উল্লেখ করেন, তৎকালীন এমপির ঘনিষ্ঠ ও মদদপুষ্ট এসব মানুষ নামে-বেনামে সরকারি টাকা লোপাট করে আসছে। ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর যারা এই অর্থ আত্মসাৎ করেছে, তাদের আইনের আওতায় এনে দ্রুত বিচার কার্যকর করার দাবি জানান পোস্টে।
পোস্টের প্রতিক্রিয়ায় নেটিজেনদের একজন বকুল রহমান লিখেছেন, আমার জানা মতে এ পাঠাগারের ( সম্ভবত মুক্তিযুদ্ধের শহীদ স্মৃতি পাঠাগার প্রসঙ্গে লিখেছেন) আপাতত কোন অস্তিত্ব চাটমোহরে নেই। সর্বশেষ এ প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি ছিল প্রয়াত উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি নজরুল ইসলাম এবং পাঠাগারটির অবস্থান ছিল কুমারগাড়া এলাকায়। ...প্রতিষ্ঠানটি গত পাঁচ-ছয় বছর অকার্যকর হয়ে পড়ে। তারপর কাগজে-কলমে প্রতিষ্ঠান থাকলেও এ প্রতিষ্ঠানের আর কেউ দায়িত্ব নেয়নি।
প্রকল্পটি প্রসঙ্গে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) এস. এম. শামীম এহসান স্থানীয় গণমাধ্যম সময়-অসময়’র সম্পাদককে জানান, আমি সরেজমিন পরিদর্শনে গেলে টুকুন ভাই প্রেসক্লাবে নিয়ে কিছু ফার্নিচার দেখিয়ে সেগুলো চাটমোহর বড়াল পাঠাগারের বলে জানান। সেখানে চাটমোহর বড়াল পাঠাগার নামে কোনো সাইনবোর্ড দেখিনি। আর চাটমোহর টিএন্ডটি অফিসের পেছনে একটি বিল্ডিংয়ে থাকা ফার্নিচার দেখে এসেছি, যেটাকে ‘মুক্তিযুদ্ধের শহীদ স্মৃতি পাঠাগার’ বলে টুকুন ভাই জানান। তবে ওই বিল্ডিংয়েও মুক্তিযুদ্ধের শহীদ স্মৃতি পাঠাগারের কোনো সাইনবোর্ড আমি দেখিনি।
উপজেলা পর্যায়ে প্রকল্প অনুমোদনে যার অন্যতম একটি ভূমিকা থাকে, তিনি হলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। প্রকল্প দুটির অবস্থান প্রসঙ্গে চাটমোহর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রেদুয়ানুল হালিম সময়-অসময় সম্পাদককে জানান, টিআর প্রকল্পের কাজ দেখার দায়িত্ব পিআইও’র। এ বিষয়ে পিআইওকে জিজ্ঞাসা করুন। প্রকল্প কমিটির কাগজে তার স্বাক্ষর প্রসঙ্গে ইউএনও বলেন, শুধু আমি কেন, ওই কাগজে আরও অনেকের স্বাক্ষর রয়েছে।
প্রকল্প দুটির সভাপতি রকিবুর রহমান টুকুন সময়-অসময় সম্পাদককে জানিয়েছেন, এ বিষয়ে তার কোনো মন্তব্য নেই। চাটমোহর উপজেলায় দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি রয়েছে। এ কমিটির সভাপতি এস. এম. মিজানুর রহমান বলেন, দুর্নীতি সেটা বড় কিম্বা ছোট- সব দুর্নীতির বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ হওয়া প্রয়োজন। তিনি আরও জানান, উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির কোনো সদস্য নিজেই যদি দুর্নীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন, সে ক্ষেত্রে কমিটির সভার মাধ্যমে তার কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হবে। পরবর্তীতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হবে।
চাটমোহর
উপজেলায় সুশাসনের জন্য নাগরিক’র কমিটি রয়েছে।
এ কমিটিতে সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সজ্জন মানুষ হিসেবে পরিচিত চাটমোহর বার্তা সম্পাদক এস. এম. হাবিবুর রহমান। তিনি প্রকল্প দুটি প্রসঙ্গে বলছিলেন, নাগরিক স্বার্থে সমাজের প্রতিটি স্তরে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়া প্রয়োজন। দুর্নীতি প্রতিরোধ না হলে সুশাসন
প্রতিষ্ঠিত হবে না। ছোট-বড় সব ধরণের
দুর্নীতি বন্ধে প্রচলিত আইন প্রয়োগের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। দীর্ঘদিনের পুরানো ও ঐতিহ্যবাহী একটি
পত্রিকার একজন সম্পাদক হিসেবে সাংবাদিকতার
দৃষ্টিকোন থেকে জানতে চাইলে তিনি বলেন, চাটমোহরে ইদানিং কোন কোন সংবাদকর্মীর অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে অন্যান্য সংবাদকর্মীকে মানহানীকর মন্তব্য শুনতে হয়। অসহনীয় তিরস্কারের সম্মুখীন হতে হয়। সে ক্ষেত্রে ওই
সব সংবাদকর্মীর অনিয়ম-দুর্নীতির খবর লিখতে হচ্ছে। এক শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা তাদের অনিয়ম-দুর্নীতি আড়াল করতে সংবাদকর্মীদেরকেও অনিয়ম-দুর্নীতির সাথে জড়ানো বা
সম্পৃক্ত করছে। আর এ জায়গা
থেকে মুক্ত অথবা অবৈধ অর্থের লোভ থেকে দূরে থাকতে না পারলে এ
মর্যাদাকর পেশা তাদের ছেড়ে দেওয়াই ভালো। বর্ণিত অবস্থায় দুর্নীতিমুক্ত সংবাদকর্মীদেও বিব্রতকর অবস্থায় দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। দুর্নীতিমুক্ত সংবাদকর্মী সৃষ্টির লক্ষ্যে দুর্নীতিবাজ সংবাদকর্মীদের চিহ্নিতকরণ, বর্জন এবং কালো তালিকাভূক্ত করে আইনের আওতায় দিতে হবে। প্রশ্নবিদ্ধ প্রকল্প দুটির বাস্তবায়নের বিষয়টি সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকে। সুত্র: সময়-অসময় ও চাটমোহর বার্তা
বিডি২৪অনলাইন/সি/এমকে