শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনামলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘ক্রসফায়ারের’ঘটনায় অন্তত ১ হাজার ৯২৬ জন নিহত হয়েছেন। দেশের এমন কোনো জেলা নেই, যেখানে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘ক্রসফায়ারে‘ ঘটনা ঘটেনি এ সময়ে। নিহতদের মধ্যে অনেক রাজনৈতিক নেতা–কর্মীও রয়েছেন। প্রতিটি ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘ক্রসফায়ারের’ঘটনার পর সরকারের তরফ থেকে ঘটনার বিবরণ প্রসঙ্গে প্রায় একই রকম গল্প বলা হয়েছে। বিচারবহির্ভূত এসব হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে মানবাধিকার সংগঠনগুলো সোচ্চার হলেও আমলে নেয়নি সরকার।
বিচারবহির্ভূত এ হত্যাকান্ডের পরিসংখ্যান সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর থেকে তথ্য নিয়ে তৈরি করেছে বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘ক্রসফায়ারে ‘ এসব ঘটনা যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, সেটা আগাগোড়াই অস্বীকার করে গেছেন শেখ হাসিনা সরকার ও তার প্রশাসন। দেশে–বিদেশে নানা সমালোচনার পরেও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করেনি শেখ হাসিনা সরকার। বরং নানাভাবে এ ঘটনাগুলোর বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেছে তারা।
এদিকে পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) হিসাবে, ২০১৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৭ বছরে ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ১ হাজার ২৯৩ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ২০১৫ সালে ১২৪ জন, ২০১৬ সালে ১৬৩ জন, ২০১৭ সালে ১৬৪ জন, ২০২০ সালে ১৪৭ জন ও ২০২১ সালে ৩০ জন রয়েছে। এসবির এ হিসাবের চেয়ে আসকের হিসাবে এ ৭ বছরে ক্রসফায়ারে নিহতের সংখ্যা ১২০ জন বেশি।
দেশে র্যাব গঠনের পর আলোচিত শীর্ষ সন্ত্রাসী ও চরমপন্থীদের প্রতিরোধে ক্রসফায়ারের সংস্কৃতি শুরু হয়ে। তখন মানুষও ক্রসফায়ারের ঘটনায় বাহবা দিতে থাকে। একপর্যায়ে পুলিশও ক্রসফায়ার শুরু করে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, ক্রসফায়ারের ক্ষেত্রে শুরুতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লক্ষ্যবস্তু ছিল আলোচিত অপরাধী বা দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীরা। কিন্তু পরবর্তীতে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ব্যক্তিগত বিরোধ, প্রভাবশালীদের নির্দেশনা এবং প্রতিপক্ষকে দমনে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও ঘটেছে।
‘ক্রসফায়ারের’ মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করার প্রবণতা ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর শুরু হয়। এসব ঘটনায় জড়িত কর্মকর্তাদের কেউ কেউ অর্থের বিনিময়ে বা অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়েও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটায়, এর বড় নজির ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনা। আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে ২০১৮ সালে ২৬ মে রাতে কক্সবাজারের টেকনাফের মেরিন ড্রাইভ সড়কে টেকনাফ পৌরসভার কাউন্সিলর একরামুল হক ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হওয়ার ঘটনা। দুটি ঘটনা সারা দেশে আলোড়ন তৈরি করেছিল।
ক্রসফায়ার সংক্রান্ত পুলিশি তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিভাগে ৪৫৯ জন, ঢাকা বিভাগে ২৯১ জন, খুলনায় ২৬০ জন, রাজশাহী বিভাগে ১১৬ জন, বরিশাল বিভাগে ২৯ জন, সিলেট বিভাগে ৩৩ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ৫৮ জন ও রংপুর বিভাগে ৪৭ জনকে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছে। ২০২১ সালের পর ক্রসফায়ার কমে যায়, এ বছরের শেষ দিকে ‘গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের’ দায়ে র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদসহ বাহিনীটির সাবেক ও তখনকার সাত শীর্ষ কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে, ২০২২ সালে ৪ জন ও ২০২৩ সালে একজন ক্রসফায়ারে নিহত হন।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ২০১৮ সালের বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের সংখ্যা অতীতের সব ঘটনাকে ছাড়িয়ে যায়। এ বছরে ৩০০টি ক্রসফায়ারের ঘটনায় ৩৫৮ জন নিহত হয়। এরপর ক্রসফায়ারের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঘটনা ঘটে ২০১৯ সালে, ক্রসফায়ারের ২৪১টি ঘটনায় ৩০৭ জন নিহত হন। ২০১৪ সালে ১২৮ জন ক্রসফায়ারে নিহত হন, এ সংখ্যা আগের পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক মৃত্যু। নবম জাতীয় নির্বাচনের পর ২০০৯ সালে ক্রসফায়ারে নিহত হন ১২৫ জন। মাঝে ২০১০ সালে ৯৩ জন, ২০১১ সালে ৬২ জন, ২০১২ সালে ৫৮ জন ও ২০১৩ সালে ৪২ জন নিহত হন।
এদিকে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে ৬৫১ জন বিএনপির নেতা–কর্মীকে ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করা হয়েছে। জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবির বলছে, তাদের ৫০ জনের অধিক নেতাকর্মীকে এ সময়ে হত্যা করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র ও সহকারী মহাপরিদর্শক ইনামুল হক সাগর গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বর্তমান পুলিশ প্রশাসন সমর্থন করে না। প্রকৃত অপরাধীর প্রচলিত আইনে বিচার হোক এটাই চায় তারা।
বিডি২৪অনলাইন/এন/এমকে