সরেজমিন খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল বিতরণ

এক কেজি করে ১৪ মণের বেশি চাল খাচ্ছে কারা?

চাটমোহর (পাবনা) প্রতিনিধি
২৭ এপ্রিল ২০২৫

শনিবার, ঘড়ির কাটায় সময় পৌনে দশটা। শহর থেকে গন্তব্য কাটাখালি বাজার। আগেই খবর ছিল- কার্ডধারীদের মাঝে চাল মাপে কম দেওয়া হচ্ছে। খুব বেশি সময় লাগেনি কাটাখালি বাজারে পৌঁছাতে। এর মধ্যে নির্মাণাধীন রাস্তায় ধুলাবালিতে কিছুটা বিরক্ত হয়ে উঠলাম, আর মাথায় উপরে চোখ রাঙিয়ে গরম ছড়াচ্ছে রোদ।

কাটাখালি বাজার হচ্ছে পাবনার চাটমোহর উপজেলার ডিবিগ্রাম ইউনিয়নের একটি বাজার। বাজারটির চার রাস্তা মোড়ে থাকা এক দোকানিকে জিজ্ঞাসা করলাম- ১৫ টাকা কেজি দরে চাল দেওয়া হচ্ছে কোথায়? বললেন, আরেকটু সামনে। কিছুটা পথ এগোতেই সামনে দেখলাম ধান-গম ভাঙানোর মিল, তার সামনে একটা ছোট্র দোকান। দোকানি বললেন, মিলের পেছনেই দেওয়া হচ্ছে ১৫ টাকা কেজি দরে চাল।

সামনে পা বাড়াবো, এমন সময় দেখলাম- কিশোর এক চালক চারটি বস্তা নিয়ে আসছে একটি ভ্যানে। সামনে দু’জন বোরকা পরিহিত মহিলা। সালাম দিলাম। বললাম- আপা, আপনি কী ১৫ টাকা কেজি দরে চাল নিলেন। বললেন,হুম। কতটুকু পেয়েছেন? সেটা তো দেখিনি, ওজন মেশিনের পেছনে দেখা যায় না। শুধু সামনে দেখা যায়, ওটা আমরা দেখতে পায়নি। যারা মেপে দিচ্ছেন, তারা শুধু ওজন দেখতে পারেন। আমার বস্তায় কতটুকু আছে, সেটা জানি না। দাম ৩০ কেজিরই নিয়েছে। বললাম, একটু সময় নষ্ট করবো আপনার, প্লিজ আপনার বস্তাটা একটু মেপে দেখাবেন। মুহূর্তের মধ্যেই তাকে উত্তরের সুযোগ না দিয়েই কিশোরকে বললাম- ভাই একটু বস্তাটা মিলের ভেতরে নাও, সেখানে দেখি ওজন কতটুকু। মহিলার চোখ-কাধের ইশারায় সায় পেয়ে কিশোর বস্তাটি কোলপাজা করে ধরে নিয়ে গেল মিলের ভেতরে।

মিলের ভেতরে ধান ভাঙানো চলছে। দু’জন মানুষ ব্যস্ত এ নিয়ে। আরেকজন কিশোর বসে আছে বেঞ্চে। আমাদের দেখেই বললো, ধান না গম? বললাম- মেশিনটা কী চালু আছে? না থাকলে একটু চালু করো তো ভাই। কিশোর কথা মতো মেশিন নিউট্রাল করলো।

বৈদ্যুতিক চার্জচালিত ওজন মেশিন। চালু করার সঙ্গে সঙ্গে মূহুর্তের মধ্যে লাল রঙের অংকে জিরো হয়ে গেল ওয়েট স্কেলবার্ড। ভ্যানটির চালক কিশোর বস্তা রেখে দিলো মেশিনের ওপর। বস্তাসহ ওজন ২৯ কেজি ২০০ গ্রাম। থাকার কথা ছিল ৩০ কেজি। কিশোরটির যখন বস্তা নিয়ে ভ্যানের কাছে ফিরে গেল, অপর নারীও তার বস্তা মেপে দেখার কথা বললো। একইভাবে তার বস্তায় পাওয়া গেল ২৯ কেজি ২০০ গ্রাম চাল।

এরই মধ্যে আরেকজন লোক ভ্যান নিয়ে আসলেন। তার ভ্যানে দুই বস্তা, আরোহী একজন। ওই দুই মহিলার মতো বস্তা দুটির একটি মেপে বস্তাসহ পাওয়া গেল ২৯ কেজি ৩০০ গ্রাম। তারাও ১৫ টাকা কেজি দরে চাল কিনে বাড়ি ফিরছেন। তাদের সঙ্গে প্রয়োজনীয় কথা বলে বের হয়ে দেখি- চাল বিতরণের জায়গায় ৫০ জনের মতো নারী-পুরুষ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ডিলার মোহাম্মদ হোসেন চাল মাপার পাশে থাকা চেয়ার-টেবিল ছেড়ে চলে এলেন আমাদের কাছে। পরিচয় দিয়ে বললাম- চাল কতুটুকু করে দিচ্ছেন? - স্যার, পাবলিকের সঙ্গে সমন্বয় করে দিচ্ছি। ২৯ কেজি করে দেওয়া হচ্ছে। ওজন কম দেওয়ার কথা স্বীকার করলেন। বললেন- কী করবো স্যার, আমরা বস্তাতেই কম পেয়েছি, দুই কেজি পরিমাণ কম দেওয়া হয়েছে; ৫০ কেজির বস্তায় ৪৮ কেজি রয়েছে। বিশ্বাস না হলে মেপে দেখেন। তার কথায় সত্যতা প্রকাশ করলো ওজন মেশিন। ৫০ কেজির বস্তা তুলে দিতেই ওয়েট স্কেলবোর্ড জানিয়ে দিল বস্তাসহ ওজন ৪৮ কেজি।

আপনার এখানে ট্যাগ অফিসার কে, তিনি কী আছেন? না স্যার, তিনি আসেননি। ভূমি অফিসের একজন আমার এখানে ট্যাগ অফিসার। বস্তায় কম চাল থাকার কথা তাকে জানিয়েছি। তিনি পাবলিকের সঙ্গে সম্বনয় করে দিতে বলেছেন।

চাল কবে থেকে দিচ্ছেন? বৃহস্পতিবার দিয়েছি। আর আজকে দিচ্ছি। ট্যাগ অফিসার প্রথম দিন এসেছিলেন? না স্যার, প্রথম দিনেও আসেনি। তবে এর আগে প্রথমবার যখন দিয়েছিলাম, ৩০ কেজির বস্তা। তখন এসেছিল।

আপনার অধীনে কতজন কার্ডধারী এ চাল পাচ্ছেন, কী পরিমাণ চাল তুলেছেন গোডাউন থেকে? ৫৭৩টি কার্ড স্যার, প্রত্যেকের জন্য ৩০ কেজি পরিমাণ, ৫০ কেজি বস্তার ডিও দিয়ে চাল তোলা হয়েছে। কথাপোকথনের ফাঁকেই প্রয়োজনীয় প্রমাণের জন্য ভিডিও সেরে নিয়েছি আমরা।

যখন ফেরার জন্য বের হবো, তখন ডিলার ও তার সহযোগীরা আমাদের পিছু নিলেন। বললেন নাস্তা করে যেতে। অনুরোধ করলেন এমন যেন কিছু না লিখি, যাতে তার ক্ষতি হয়। ডিলারের সহযোগীদের একজন বলেই ফেললেন- যান, সন্ধ্যায় আপনাদের সঙ্গে দেখা করবো। আমাদের তরফ থেকে জানিয়ে দেওয়া হলো- আমরা চাও খাবো না আপনাদের সঙ্গে, নাস্তা তো অবশ্যই খাবো না।আপনার চাল বিতরণের বিষয়ে যোগাযোগ করার দরকার নেই, যোগাযোগ করবেন না প্লিজ।

রোদ রেগে যাচ্ছে, গরমে শরীর থেকে ঘাম ঝরছে। অভিযোগের সত্যতার পাশাপাশি প্রমাণ হাতে পাওয়া গেছে। এবার ফেরার পালা। বাইকে ফেরার পথে আমরা হিসাব করছি- কার্ড প্রতি এক কেজি করে কম দিলে সব মিলে ৫৭৩ কেজি চাল কম দেওয়া হচ্ছে। ৪০ দিয়ে ভাগ করে মণের হিসাব করলে সেটা ১৪ মণের বেশি চাল কম দেওয়া হচ্ছে। গরীবের জন্য দেওয়া এতো চাল খাচ্ছে কারা? কোথায় চাচ্ছে এ চাল?   

চালের ঊর্ধ্বগতির বাজারে গরীব মানুষের কথা চিন্তা করে হতদরিদ্র মানুষকে খাদ্য বান্ধব কর্মসূচির আওতায় নিয়ে এসেছে সরকার। এ কর্মসূচির আওতাভুক্ত সুফলভোগী কার্ডধারীদের প্রত্যেককে ১৫ টাকা দরে ৩০ কেজি চাল দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু গরীবের এ চালে যারা ভাগ বসাচ্ছে, তারা কিন্তু মানসিকভাবে দরিদ্রদের চেয়েও গরীব। কেননা, তালিকাভুক্ত হতদরিদ্ররা সংখ্যায় বেশি হলেও বিক্ষোভ বা প্রতিরোধ গড়ে না তুলে নিজেদের অসহায়ত্ব মেনে নিয়ে তাদের নায্য হক  চালখোরদের খেতে দিচ্ছে!

চলমান খাদ্য বান্ধব কর্মসূচি প্রসঙ্গে উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আইনিন আফরোজ খাতুন  জানালেন, এটা সরাসরি ভোক্তার কাছে যাবে। ১৫ টাকা কেজি দরে বিতরণ করতে হবে। কর্মসূচির আওতাভুক্ত সুবিধাভোগীদের তালিকা ধরে চাল বিতরণ হবে। তিনি জানান, সপ্তাহের ৫ দিন এ বিতরণ করা হচ্ছে। তবে ভোক্তার চাহিদার ভিত্তিতে শনিবারেও দেওয়া যাবে, তবে তালিকার বাইরে কাউকে দেওয়ার সুযোগ নেই। তিনি জানান, কোনোভাবেই পরিমাপে চাল কম দেওয়া যাবে না। ডিলার খাদ্য গুদাম থেকে ওজন দিয়ে চাল বুঝে নেবেন। এরপর ভোক্তার মাঝে বিতরণ করবে। তিনি বলেন, ৫০ কেজির চালের বস্তায় দুই-একটার ক্ষেত্রে হয়তো একটু কম-বেশি থাকতে পারে। দুই-তিন কেজি কম, এটা হতেই পারে না। কিন্তু তার জন্য ভোক্তাকে কেজি করে কম দেওয়ার কোনো যুক্তি নেই। আমি এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছি।  

 

বিডি২৪অনলাইন/সি/এমকে



মন্তব্য
জেলার খবর