কানু সান্যাল, পাবনা
গত বছরও ঈদে কাঙ্খিত ব্যবসা হয়নি, পুঁজি হারিয়েছেন অনেকেই। স্বপ্ন ছিল সামনের বছর ক্ষতি কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াবেন। কিন্তু গতবারের মতো এবারও শুরুতেই ধাক্কা দিয়েছে করোনা। তাই ব্যবসা নিয়ে বিচলিত স্থানীয় তাঁতীরা। হুমকির মধ্যে পড়েছে এ শিল্প। ইতোমধ্যেই বন্ধ হয়েছে চার লাখ তাঁত, আগে সচল ছিল ছয় লাখ। ক্রমাগত লোকসান আর করোনার ধাক্কায় পুঁজি হারানোয় এ দশা। তাঁত বন্ধ ও তার কারণের তথ্য পাওয়া গেছে তাঁত ব্যবসায়ী সমিতি থেকে। এ ঘটনা পাবনা ও সিরাজগঞ্জের। তাঁত শিল্পকে বাঁচাতে সংকট নিরসনে সরকারের কাছে সহযোগিতার দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
সুত্র জানায়, প্রতিবছর রোজার দুই সপ্তাহ আগে থেকেই পাবনা ও সরিাজগঞ্জরে তাঁত কাপড়ের হাটে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকার ব্যবসায়ীরা কাপড় কিনতে আসেন। এ বছর করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকার বিধি-নিষেধ আরোপ করায় হাটে আসতে পারেনি ক্রেতারা। ২৫ এপ্রিল থেকে দোকান ও শপিংমল খুলে দেয়ার পরে কিছু কিছু পাইকার হাটে এলেও এখনো ঈদের কাঙ্খিত ব্যবসা শুরু হয়নি বলে দাবি করেছেন তাঁতিরা।
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের বৃহত্তম তাঁত কাপড়ের পাইকারী হাটের ব্যবসায়ী রহমত আলী জানান, স্বাভাবিক সময়ে প্রতি হাটবারে তার দোকান থেকে প্রায় ৫০০ থেকে ৮০০ পিস কাপড় পাইকাররা কিনতেন। তবে এ বছর করোনার কারণে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকাররা আসতে না পারায় বিক্রির পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে।
বাংলাদেশ স্পেশালাইজড টেক্সটাইল মিলস এন্ড পাওয়ারলুম ইন্ডাসট্রিজ এসোসিয়েশনের (বিএসটিএমপিআইএ) পরিচালক মো. হায়দার আলী বলেন, স্বাভাবিক সময়ে প্রতিবছর ঈদের সময় প্রতি হাটে প্রায় দুইশ কোটি টাকার বেশি তাঁত কাপড় বিক্রি হতো শাহজাদপুর হাটে। কিন্তু করোনার কারণে গত বছর অর্ধেক কাপড় বিক্রি করতে পারেনি তাঁতিরা। একই অবস্থা এ বছরেও। কয়েক সপ্তাহ বন্ধ থাকার পর হাট শুরু হলেও আশানুরূপভাবে বিক্রির পরিমাণ বাড়েনি। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকাররা না আসায় দেশের অন্যতম বৃহত্তম তাঁত কাপড়ের হাটের পাইকার ব্যবসায় ধ্বস নেমেছে।
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার রূপপুর গ্রামের তাঁত কারখানার মালিক আল-আমিন হোসেন বলেন, ‘গত দুই বছরে টানা লোকসানে অর্থ সংকটে পড়েছে আমার কারখানা। আমার এখানে প্রায় ৩০টি তাঁত আছে। অর্থ সংকটের কারণে গত কয়েক মাস কারখানা বন্ধ ছিল। অবশেষে ব্যাংক থেকে ১০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে এ বছর ঈদে ব্যবসা করতে কারখানা চালু করি। কিন্তু চালু করার উদ্যোগ নেওয়ার পরপরই শুরু হয় লকডাউন। এ অবস্থায় কারখানা চালু করলেও ব্যংক ঋণের কিস্তি টাকাও তুলতে পারব না।’ একই এলাকার তাঁত ব্যবসায়ী মো. আতিক বলেন, ‘আমার প্রায় ২০টি তাঁতের আটটি তাঁতই বন্ধ। গত বছরের অর্ধেক কাপর এখনো পড়ে আছে। তবে ঈদের বাজার সামনে রেখে আবারও উৎপাদন শুরু হয়েছে। প্রতিদিন ৬০ থেকে ৮০টি কাপড় তৈরি হলেও বিক্রি না থাকায় বেশিরভাগ কাপড় জমে আছে ঘরে।’
এদিকে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছেন এখানকার দরিদ্র তাঁত শ্রমিকরা। বছরের এ সময়ে তারা উৎসবের আমেজে কাজ করে, সারা বছরের উপার্জনের বেশিরভাগ আসে রমজান মাসে। কিন্তু করোনার কারণে তাদের অনেকেই এখন কর্মহীন। সিরাজগঞ্জের তাঁত শ্রমিক আব্দুল জলিল বলেন, ‘প্রতি বছর আমরা রোজার সময়ে বছরের সবচেয়ে বেশি আয় করি। এ বছর কাজ শুরু হলেও বিক্রি কমে যাওয়ায় কারখানার উৎপাদনও কমে গেছে। অন্যান্য বছর ঈদের এ সময় আমরা প্রতিদিন ১০ থেকে ১২টি শাড়ি তৈরি করি, এজন্য প্রায় এক হাজার থেকে এক হাজার দুইশ পর্যন্ত আয় হতো। এ বছর উৎপাদন কম হওয়ায় প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৬০০ টাকার বেশি আয় হচ্ছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে আমাদের পৈত্রিক পেশা ছেড়ে চলে যেতে হবে।
বাংলাদেশ হ্যান্ডলুম ও পাওয়ারলুম এসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি ও সিরাজগঞ্জ জেলা কমিটির সভাপতি হায়দার আলী বলেন, ‘ঋণ করে যারা উৎপাদন শুরু করছেন, তারাও পণ্য বিক্রি করতে না পারায় ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে চাইছে।’ হায়দার আলী আরও বলেন, ‘দেশের উৎপাদিত মোট তাঁত কাপড়ের প্রায় ৪৮ ভাগ কাপড় উৎপাদিত হয় পাবনা ও সিরাজগঞ্জে। এ দুই জেলার প্রায় ৩০ লাখ মানুষ তাঁত শিল্পের সঙ্গে জড়িত।’
বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের উপ-মহাব্যবস্থাপক রতন চন্দ্র সাহা বলেন, ‘আমরা প্রান্তিক তাঁতিদের সহযোগিতা দিয়ে থাকি। ৩-৫টা তাঁত আছে যাদের, তাদের প্রান্তিক তাঁতি বলা হয়ে থাকে। তাদের ব্যবসায়ের জন্য আমরা ৩০ হাজার থেকে ৩ লাখ টাকা ঋণ দিয়ে থাকি। তবে করোনার কারণে বড় ধরনের ক্ষতির ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। হয়তো সরকার সময়োপযোগী কোনো উদ্যোগ নেবেন।
এমকে