দীপক সরকার, বগুড়া
সকাল হলেই নারী-পুরুষ কলসি, পাতিল, বালতিসহ বিভিন্ন পাত্র নিয়ে সারিবদ্ধভাবে রওনা দেন। পাড়ি দেন ১ কিলোমিটার পথ। এরপর সেখান থেকে হাতে, কাঁধে বা ভারে পানি ভর্তি সেই পানির পাত্র নিয়ে ফেরেন বাড়ির পথে। এভাবে সংগ্রহ করা পানিতে চলে থালাবাসন ধোয়া, গোসল, রান্নাবান্নার কাজ, মেটানো হয় দৈনন্দিন পানির চাহিদা। চলতি শুস্ক মৌসুমে প্রতিদিনই নিয়ম করে এভাবে পানি আনতে দেখা যায় বগুড়ার শেরপুর উপজেলার রামেশ^রপুর গ্রামের বাসিন্দাদের। পানির স্তর নেমে যাওয়ায় ওই গ্রামে দেখা দিয়েছে তীব্র পানির সংকট। ভোগান্তিতে পড়েছেন গোটা গ্রামের মানুষ। গ্রামটিতে হাজারো পরিবারের বসবাস।
সরেজমিনে গত রোববার (৯ মে) বিকালে রামেশ্বরপুরগ্রামসহ নিকটবর্তী কয়েকটি গ্রামে গেলে ভূক্তভোগীদের পানি সংগ্রহের এমন দৃশ্য চোখে পড়ে। নিকটবর্তী গ্রামের মধ্যে আছে গাড়ীদহ, খামারকান্দি, খানপুর, সীমাবাড়ী ও সুঘাট ইউনিয়নের কিছু গ্রাম। এসব এলাকায় পানির স্তর ঘরবাড়িতে ব্যবহৃত হস্তচালিত নলকূপগুলোর আওতার বাইরে চলে গেছে। তাই হাজার হাজার অগভীর নলকূপে পানি ওঠা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।
পানি সংকটের দুর্ভোগে নতুন মাত্রা যোগ হয় যখন বিদ্যুৎ বিভ্রাট চলে। কেননা, সব কাজ ফেলে তখন অতি প্রয়োজনীয় পানির জন্য অপেক্ষা করতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এ ছাড়া পানি সংকটের কারণে বছরের এ সময়টিতে এলাকার স্থানীয় বাসিন্দারা তাদের স্বজনদের বেড়াতে আসতে বলেন না। জামাই-মেয়েকে দাওয়াত করতে পারেন না। পানীয় জলের সংকটে তাদের আপ্যায়নে ভীষণ সমস্যায় পড়তে হয়।
উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর সূত্র জানায়, এ উপজেলায় সর্বমোট সরকারি-বেসরকারি মিলে অন্তত ১৫ হাজার হস্তচালিত নলকূপ রয়েছে। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় সিংহভাগ নলকূপই অকেজো হয়ে পড়েছে। সেগুলোতে পানি ওঠা একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে।
স্থানীয়রা জানান, জানুয়ারি মাস থেকে পানির স্তর নিচে নামতে শুরু করলেও চলতি মাসে এসে তা চরম আকার ধারণ করেছে। ফলে শেরপুর উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নের প্রায় ৫০টি গ্রামে বিশুদ্ধ খাওয়ার পানির জন্য চলছে হাহাকার। রামেশ্বর গ্রামের বাসিন্দা আছিয়া বিবি, মাজেদা বেগম ও বাংড়া গ্রামের গোলাম মোস্তফা, শফিকুল ইসলাম বলেন, এসব এলাকার অধিকাংশ এলাকার পানির স্তর ৩৫ থেকে ৪০ ফুট পর্যন্ত নেমে গেছে। পানির স্তর নেমে যাওয়ায় বেশির ভাগ হস্তচালিত নলকূপে পানি ওঠা বন্ধ হয়ে গেছে। যেগুলোতে যাও ওঠে, তাতে পরিবারেরই হয় না। সেচ সংকটের পাশাপাশি পানীয় জলের অভাব প্রকট হয়ে উঠেছে। ফলে বাধ্য হয়ে এসব গ্রামের লোকজন গভীর নলকূপ থেকে পানি সংগ্রহ করছেন।
গাড়ীদহ গ্রামের ভ্যানচালক মুক্তার হোসেন, মুদি দোকানদার আবদুর রহিম, শাফায়াত বলেন, কাজ থাকলে এখন সময় বেঁধে পানি আনতে হয় পরিবারের জন্য। সংগ্রহ করে আনা পানি দুই-তিন দিন ধরে সংরক্ষণ করে রাখা হয়। খাওয়ার পানির এমন সংকট গত কয়েক বছরেও হয়নি। এ ছাড়া পানি-সংকটে গরু, মহিষ, মানুষ একই ডোবা বা পুকুরে গোসল করছে। বাড়ির নলকূপে পানি ওঠা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাদের বাড়িতে এক কিলোমিটার দূরের শ্যালোমেশিন থেকে পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে।
শেরপুর উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী সাহাবুল ইসলাম বলেন, উপজেলার প্রায় সব ইউনিয়নের পানির স্তর ইতোমধ্যে ৩০ থেকে ৩৫ ফুট নিচে নেমে গেছে। পানির স্তর ১৬ থেকে ১৮ ফুট নিচে থাকলে সেটাকে আমরা স্বাভাবিক বলে থাকি। জলবায়ুর পরিবর্তন ও নদী-নালা, খাল-বিল ভরাট হয়ে যাওয়ায় দিন দিন এসব সমস্যা প্রকট হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে নদী খনন করে এবং বিশেষ ব্যবস্থায় পানির রিজার্ভ রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
এমকে