হেনস্তা শেষে সাংবাদিককে থানায় হস্তান্তর: মামলা, বিক্ষোভ

১৮ মে ২০২১

পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সোমবার বিকালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের চাকুরেদের হাতে শারিরীকিভাবে লাঞ্ছিতসহ চরমভাবে হেনেস্তার শিকার হয়েছেন প্রথম আলোর সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম। মন্ত্রণালয়ের একটি কক্ষে পাচঁ ঘণ্টার বেশি সময় আটকে রেখে হেনেস্থা শেষে তাকে শাহবাগ থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে। হেনেস্থাকালে অসুস্থ হয়ে পড়েলও হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়নি তাকে। এ ঘটনায় ভুক্তভোগীর নামে সরকারি নথি চুরির অভিযোগ এনে মামলা করেছেন মন্ত্রণালয়ে কর্মরত এক চাকুরে। মন্ত্রণালয়টির নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করায় সংক্ষুব্দ চাকুরেরা পরিকল্পিতভাবেই এ ঘটনা ঘটায় বলে অভিযোগ ওঠেছে।

এদিকে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে একজন সাংবাদিকের সঙ্গে ঘটানো এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনায় ফঁসে ওঠছে গোটা সাংবাদিক সমাজ। তারা সচিবালয় ও শাহবাগ থানা চত্তরে বিক্ষোভ করেছেন। বিক্ষোভ থেকে রোজিনা ইসলামের মুক্তির পাশাপাশি ঘটনায় জড়িতদের বিচার দাবি করেছেন সরকারের কাছে। এ ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট (সিপিজে), অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংগঠন। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিরা ঘটনার প্রতিবাদ জানাচ্ছেন।

রাত পৌনে ১২টার দিকে পুলিশ জানায়, রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে মামলা হয়েছে। তাঁকে এ মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। পেশাগত কাজে দুপুরের পর সচিবালয়ে যান রোজিনা ইসলাম। বেলা তিনটার দিকে সচিবালয়ে দায়িত্ব পালন করা সাংবাদিকেরা জানতে পারেন, রোজিনা ইসলামকে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবের একান্ত সচিবের কক্ষে আটকে রাখা হয়েছে। তাঁর মুঠোফোন কেড়ে নেয়া হয়েছে। এরপর সাংবাদিকেরা সেখানে ছুটে যান। কয়েকজন সাংবাদিক কক্ষের ভেতরে গেলে রোজিনা ইসলাম বলেন, তাঁকে মিজান নামের এক পুলিশ সদস্য নাজেহাল করেছেন। ঘটনার সম্পর্কে উপস্থিত সাংবাদিকেরা কয়েক দফা স্বাস্থ্যসেবা সচিব লোকমান হোসেন মিয়ার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলেও কথা বলতে চাননি তিনি, উপস্থিত সাংবাদিকদের সঙ্গে দেখাও করেননি। দীর্ঘ সময় রোজিনাকে আটকে রাখার কারণ সম্পর্কে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অন্য কর্মকর্তারাও পরিষ্কার করে সাংবাদিকদের কিছু বলেননি। একপর্যায়ে সাংবাদিকেরা ক্ষোভ জানান। তাঁরা রোজিনা ইসলামকে হেনস্তা ও আটকে রাখার প্রতিবাদ করেন। হেনেস্তার কারনে অসুস্থ বোধ করা রোজিনা ইসলামকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দেয়ার দাবি জানান। পরে রাত সাড়ে আটটায় তাঁকে ধরাধরি করে নারী পুলিশ সদস্যরা ওই কক্ষ থেকে বের করে নিচে নামিয়ে আনেন এবং গাড়িতে তুলে শাহবাগ থানায় নিয়ে যান।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ তথ্য কর্মকর্তা মাইদুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, রোজিনা ইসলাম সচিবের পিএসের কক্ষ থেকে মোবাইল ফোনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথির ছবি তোলেন। কিছু কাগজপত্র নিয়ে যাচ্ছিলেন। এ বিষয়ে তাঁর বিরুদ্ধে উপসচিব শিব্বির আহমেদ ওসমানী থানায় অভিযোগ দিয়েছেন। এদিকে রাত ১০টার দিকে শাহবাগ থানায় রোজিনা ইসলামের সঙ্গে দেখা করে এসে তাঁর বোন সাবিনা পারভীন সাংবাদিকদের বলেন, আটকের পর তাঁর বোনের ব্যাগ কেড়ে নেয়া হয়। তখন ব্যাগে কিছু ‘ডকুমেন্ট’ ঢুকিয়েও দিয়ে থাকতে পারে। রোজিনা ইসলামের শারীরিক অবস্থা নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেন তাঁর বোন।

এদিকে রোজিনা ইসলামকে শাহবাগ থানায় নেয়ার পর রাতে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকেরা সেখানে গিয়ে অবস্থান নেন। তাঁরা সেখানে বিক্ষোভ করেন এবং রোজিনাকে মুক্তির দাবি জানান। সাংবাদিকেরা এ ঘটনায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্যসচিবের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, রোজিনা ইসলাম পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গেলে তাঁকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে রাখা অন্যায়, অনভিপ্রেত। রোজিনাকে হেনস্তা করার পেছনে দায়ী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে হবে। রোজিনা ইসলামকে হেনস্তা করার পেছনে দায়ী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে বলেছে এডিটরস গিল্ডও। এক বিবৃতিতে তারা বলেছে, সরকারের নীতি যেখানে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, সেখানে আমলাতন্ত্রের ভেতরে বা প্রশাসনের অভ্যন্তরে কারা এসব কাজ করে গণমাধ্যমকে সরকারের মুখোমুখি দাঁড় করাচ্ছে তারও তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের আরেক অংশের সভাপতি এম আব্দুল্লাহ বলেন, রোজিনা ইসলামের সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছে, তা ন্যক্কারজনক। এ ঘটনায় সাংবাদিকেরা উদ্বিগ্ন, ক্ষুব্ধ ও বিস্মিত। স্বাধীন ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা এবং মুক্ত গণমাধ্যমের প্রতি ধারাবাহিক আক্রোশেরই প্রতিফলন এটা। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম খান বলেন, কোনো নিরপরাধ সাংবাদিক যেন হয়রানির শিকার না হন, সেটা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি মুরসালিন নোমানী অবিলম্বে রোজিনা ইসলামকে পুলিশি হেফাজত থেকে ছেড়ে দেয়ার দাবি জানান। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক মসিউর রহমান খানও প্রতিবাদ জানিয়েছেন। শেষ খরব পাওয়া পর্যন্ত রোজিনা ইসলামকে আদালতে পাঠিয়েছে পুলিশ।

এমকে


মন্তব্য
জেলার খবর