মাহমুদ শরীফ, কুমারখালী (কুষ্টিয়া)
দেখলেই বোঝা যায় দোকানের সাইনবোর্ডে লেখা নামটাই বহন করছে আলাদা আর গতানুগতিকের বাইরের ইঙ্গিত। দোকানের নাম ‘ভিন্ন রকম দোকান-তায়েবা রোমাল’। একদম ভিন্ন রকমই বটে! কেননা, এ দোকানে কোনো দোকানদার বা বিক্রেতা বসে নেই। তারপরও পাঁচ বছর ধরে পণ্য বিক্রি নিয়মিত চলছে দোকানটিতে । বিস্ময়কর বিষয় হলেও সত্য দোকানের একটি পণ্যও কোনো দিন চুরি হয়নি।
এ সমাজে সুযোগ পেলেই যেখানে ঠকানোর দোকান খোলেন অনেকে, সেখানে অবিশ্বাস্য হলেও দোকানে না বসেই এমন একটি দোকান পরিচালনা করছেন হামিদুর রহমান শিপন। মুলতঃ পেশায় তিনি হকার। কুষ্টিয়ার কুমারখালী রেল ষ্টেশনের ছাত্রী ছাউনির পাশেই তার এ দোকান।
বিক্রেতা না থাকলে পণ্যের দাম পরিশোধ হয় কিভাবে? দোকানে সব পণ্যের গায়ে মূল্য লেখা আছে। ক্রেতা পছন্দের পণ্য কিনে একটি ক্যাশ বক্সে টাকা রেখে তার দাম পরিশোধ করছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া দোকানটি দেখতে অনেকেই ছুটে আসছেন। ফলে বাড়ছে বিক্রিও।
হামিদুর রহমান শিপন বলেন, ‘আমি পেশায় ক্ষুদ্র হকার। শুধু দোকানে বসে থাকলে পরিবারের খরচ জোগাতে পারব না। আর যে দোকান দিয়েছি, সেই দোকানে বসে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না। কেননা, দৈনিক সংসার চালানোর খরচ দোকান থেকে উঠে না। তাই দোকান খুলে রেখে আমি বিভিন্ন স্থানে হকারি করে পন্য বিক্রি করি। ক্রেতারা দোকানে এসে জিনিস পছন্দ হলে সেটা মূল্য তালিকা দেখে ক্রয় করে টাকা বাক্সে ফেলে রেখে চলে যান।
ভিন্ন প্রক্রিয়ায় ব্যবসা পরিচালনায় ইতোমধ্যেই স্থানীয়দের কাছে ‘ভিন্ন শিপন’ হিসেবেই পরিচিতি পেয়েছেন তিনি। ভিন্ন শিপন জানান, আমি মানুষকে বিশ্বাস করি আর বিশ্বাসের উপর দোকান করেছি। বছরের পর বছর এভাবেই চলছে। দৈনিক ২০০ থেকে ৪০০ টাকা আয় হয়। যেদিন যে জিনিসগুলো বিক্রি হয়েছে, সেগুলোর টাকা তিনি বাক্সে পেয়েছেন। কোনো দিনও হিসাবে টাকা কম পড়েনি বলে জানান তিনি। সকালে দোকান খুলে রেখে হকারী পেশায় নেমে পড়ে। সন্ধার পরে ফিরে দোকান বন্ধ করেন।
এ দোকানে আসা ক্রেতা সোহাগ জানান, লোকমুখে শুনে আমি এ দোকানে এসেছি। আমার জীবনে দেখা এটা একটা ব্যতিক্রমধর্মী দোকান। দোকানদার মানুষকে বিশ্বাস করে, তাই তার বিশ্বাসের মর্যাদা দেয়া উচিৎ বলে মনে করেন এ ক্রেতা। অবশ্য শিপন তার এ দোকানের পাশের মার্কেটে আরেকটি দোকান দিয়েছেন। যার নাম ‘অন্য রকম দোকান‘। সেখানে একজন কর্মচারী রেখেছেন। নিজেও সময় দেন মাঝে মাঝে।
জানা গেছে, শিপন সুযোগ পেলেই সামাজিক কর্মকান্ড ও মানবতার কাজে নিজেকে বিলিয়ে দেন। বিশেষ করে প্রচন্ড গরমে পানির পিপাসায় ট্রেনের যাত্রীরা যখন হাসফাস করে, শিপন পানির বালতি আর ২/৪ গ্লাস নিয়ে পানি খাওয়ানোর জন্য হাজির। ‘পানি খান! পানি আছে! পানি খান! কোনো টাকা লাগবে না! শিপনের ঘোষণা শুনেই পিপাসায় কাতর যাত্রীরা পানির জন্য হাত বাড়ায়। ঢক ঢক করে পানি পান করে তৃপ্তির মুচকি হাসি দিয়ে ধন্যবাদ জানায়। শিপনের পানি পান করানোর কাজে অনেকেই স্বেচ্ছায় সাহায্যের হাত বাড়ান। ষ্টেশনে সে একটি অস্থায়ী পানির ট্যাপও বসিয়েছেন। এর বাইরেও স্বেচ্ছাশ্রমে তিনি আরেকটি কাজ করেন, পবিত্র রমজান মাসে সেহেরীর সময় মানুষকে জাগিয়ে দেন ঘুম থেকে, নিজেই মাইকিং করে। এলাকায় কেউ মারা গেলে সেই ঘোষণা প্রচারও করছেন ইদানিং।
শিপন জানায়, আমার সাধ অনেক সাধ্য কম। যতটুকু পারছি, ততটুকু বিনে পয়সায় খেদমত করেই যাবো ইনশাল্লাহ!
এমকে