‘গহীন পানির স্রোতের মদ্দিখানে স্বপ্ন ভাসিচ্চে’

০৫ অগাস্ট ২০২১

দীপক সরকার, বগুড়া:

প্রমত্তা নদীর দিকে তাকিয়ে নিজেদের আদি ও পৈত্বিক ভিটা কোথায় ছিল- তার বিবরণে বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে যমুনা নদীরপাড়ের লোকালয় চরদলিকায় বাস করা নব্বই বছর বয়সী সাহেব আলী তার আঞ্চলিক ভাষায় বলেন, ‘ওই জাগাত হামার ঘর আছিল, বাড়ির চারদিকে আছিল নানান জাতের ফল ও কাঠের গাছ, বাঁশঝাড় ভরা আছিল তরলা আর মাকলা বাঁশ। ওই বাড়ি হামার বাপ দাদার বাড়ি। ওটি হামার বাবা-মার কবর, হামার দাদার কবর, হামার কয়েক গোষ্ঠীর কবর। ওই জাইগ্যেৎ হামি বড় হছি, হামার পোলাপানও বড় হছে, কত পুরানো স্মৃতির জায়গা, সব্বনাইশে যমুনা হামাগোরে সব কাড়ে নিয়্যাচে, একুন গহীন পানির স্রোতের মদ্দিখানে স্বপ্ন ভাসিচ্চে।’

সাহেব আলীর মতোই নিজেদের বসতভিটা ও আর জমিজিরাত নদীগর্ভে বিলীনের বর্ণনা দেন যমুনা নদীপাড়ের কামালপুর গ্রামের বাসিন্দা বৃদ্ধ আব্দুর রশিদ, রশিদ ফকির, শাব্দুল হাকিম, রহিম আলী ও রমজান আলী । বর্তমানে তারা পরিবার নিয়ে বেড়িবাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন।

 

&dquote;&dquote;

 

গত কয়েকদিন ধরেই নদীপাড়ের রৌহাদহ, ইছামারা, গোদাখালী এবং সদরের চরবাটিয়ার কয়েক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে দেখা দিয়েছে নদী ভাঙন। হুমকির মুখে পড়েছে কুতুবপুর ইউনিয়নের ধলিরকান্দি হতে রৌহাদহ পর্যন্ত প্রায় ৮ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধ। বাঁধের বিভিন্ন স্থানে সৃষ্টি হয়েছে ছোটবড় অনেক ফাটল। ধসে যাচ্ছে এটিকে রক্ষাকারী সিসি ব্লক। বেড়িবাঁধটি ভেঙে গেলে প্লাবিত হবে পূর্ব বগুড়ার চারটি উপজেলার প্রায় অর্ধ শতাধিক গ্রাম। তলিয়ে যাবে কয়েক হাজার হেক্টর জমির ফসল। পানিবন্দি হবেন লাখো মানুষ। এ আশংকায় যমুনা তীরবর্তী মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছে।

সরেজমিনে জানা যায়, গত তিন মাসে যমুনার ভাঙনে নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে প্রায় পাঁচ শতাধিক ঘরবাড়ি। ভুক্তভোগীরা আশ্রয় নিয়েছে জামালপুর জেলার ইসলামপুর এলাকায়। হাটবাড়ি গ্রামের ৮০টি পরিবার তাদের বাড়িঘর অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছেন। হাটবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভাঙনের দ্বারপ্রান্তে। ভাঙনে মানচিত্র থেকে প্রায় মুছে যেতে বসেছে চরদলিকা নামের একটি চর। কাশিরপাড়া গ্রামের বেশিরভাগ বসতভিটা দেবে যাচ্ছে। এ গ্রামের ৬০টি পরিবারও অন্যত্র সরে গেছে। আর ১০০ মিটার ভাঙলেই এ গ্রামের ভাঙ্গরগাছা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় যমুনায় হারিয়ে যাবে। এছাড়া গ্রামটির মসজিদও নদীগর্ভে বিলীন হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন এলাকাবাসী। শিমুলতাইড় গ্রামে ৬০টির বেশি পরিবারের বসতভিটা নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। শিমুলতাইড় প্রাথমিক বিদ্যালয় ভাঙনকবলিত এলাকা থেকে মাত্র দুইশ মিটার দূরে অবস্থান করলেও মসজিদটি ভেঙে নদীতে দেবে গেছে।

তার নিজের বাড়িই ১১ বার ভেঙেছে উল্লেখ করে চালুয়াবাড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শওকত আলী জানান, ভাঙনের ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা আমাকে ত্রাণ ও খাদ্য সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন।

সারিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রাসেল মিয়া বলেন, যমুনার ভাঙন কবলিত এলাকায় জিআরএর চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তাছাড়া ওই এলাকায় সর্বোচ্চ ত্রাণ সহায়তা দেয়ার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

বগুড়া জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহবুবুর রহমান জানিয়েছেন, যমুনার পানি কমতে শুরু করায় কয়েকটি পয়েন্টে ভাঙন শুরু হয়েছে। ভাঙন ঠেকাতে এ বছর ৩০ মিটারে জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছে। নদী ভাঙন রোধে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে আমরা আন্তরিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছি।

 

এমকে

 


মন্তব্য
জেলার খবর