নূরুজ্জামান শেখ, বাগেরহাট:
সুন্দরবনের খাল ও নদীতে কীটনাশক দিয়ে মাছ শিকার করছেন জেলে নামধারী সংঘবদ্ধ একটি চক্র।বিষ দেয়ায় শুধু মাছ-ই মারা যাচ্ছে না, বরং ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অন্যান্য জলজ ও বন্য প্রাণীও। এতে একদিকে বিরূপ প্রভাব পড়ছে বনের জীববৈচিত্র্যের ওপর। অন্যদিকে স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে উপকূলীয় অঞ্চলের বাসিন্দাদের।নাম প্রকাশ না করার শর্তে কিছু জেলে জানান, বন বিভাগের অজান্তে বিষ দিয়ে মাছ শিকার কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এ কাজে সহায়তা করছে বন বিভাগের অসাধু কিছু কর্মচারী।
এদিকে বিষ দিয়ে মাছ ধরা ঠেকাতে বেশে তৎপর রয়েছে বন বিভাগ, কোস্টগার্ড ও পুলিশ। বিষ দিয়ে ধরা মাছ, নৌকা, ট্রলারসহ বেশ কয়েকজন জেলেকে আটক করা হয়েছে ইতোমধ্যেই। তারপরও দৌরাত্ম্য কমছে না চক্রটির।
বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বনের মধ্যে আঁকা-বাকা নদী, খাল ও তিন নদীর মোহনা রয়েছে সতের শ’ বর্গকিলোমিটার। নদ-নদীতে রয়েছে বিলুপ্তপ্রায় তালিকায় থাকা ইরাবতীসহ ৬ প্রজাতির ডলফিন ও ২১০ প্রজাতির মাছ।
সুন্দরবন সংলগ্ন রায়েন্দা এলাকার তরিকুল ও জান্নাত নামের দুই জেলে জানান, গত কয়েক বছর ধরে বনে বিষ দিয়ে মাছ শিকার বেড়েছে। প্রথম দিকে অল্প কিছু খালে বিষ দিলেও দিন দিন তা ভয়ঙ্করভাবে বাড়ছে। এতে আমাদের মত সাধারণ জেলেদের ক্ষতি হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। আমরা না পারি বিষ দিতে, না পারি ভালোভাবে মাছ ধরতে। আমরা বাপ-দাদার আমল থেকেই মাছ ধরে সংসার চালাই। বিষ দিয়ে মাছ শিকারের দায়ে জেল হয় মোংলা চিলা এলাকার এক জেলের। সম্প্রতি জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন তিনি, নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কয়েক বছর আগে মাছ ব্যবসায়ীদের পরামর্শে মাছ ধরতে বিষ প্রয়োগ করা শুরু করি। এতে অল্প সময়ে বেশি মাছ পাওয়া যায়।
সেভ দ্যা সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, কীটনাশক দিয়ে মাছ ধরায় শুধু সুন্দরবনের মৎস্য সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না, এ বিষাক্ত পানি পান করে বাঘ, হরিণ, বানরসহ অন্য বন্য প্রাণীরাও হুমকির মধ্যে পড়ছে। অন্যদিকে উপকূলীয় এলাকায় মানুষের পানীয় জলের উৎসগুলোও বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে। আর এ পানি পান করে শারীরিক নানা রকম ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছে তারা।
সুন্দরবন সুরক্ষা কমিটির আহবায়ক নজরুল ইসলাম আকন বলেন, প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের ছত্রচ্ছায়ায় একশ্রেণির জেলে নৌকা ও ট্রলার নিয়ে বনের ভেতরে ঢুকে বিষ দিয়ে মাছ শিকার করছেন। এতে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমরা অনেক সময় বিভিন্ন সভায় এ নিয়ে কথাও বলেছি। তারপরেও অদৃশ্য্ কারনে কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহন করা হয় না।
বিষ দিয়ে মাছ ধরার ফলে খাদ্যচক্রেও ব্যাপক প্রভাব পড়ে বলে জানালেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান অনুষদের প্রভাষক রাবেয়া সুলতানা। বললেন, কীটনাশক যেখানে প্রয়োগ করা হয়, সেখানে ছোট-বড় সব প্রজাতির মাছ মারা যায়। মাছের পাশাপাশি জলজ উদ্ভিদও (মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য কণিকা) মারা যাচ্ছে। ফলে খাদ্য সঙ্কট তৈরি হচ্ছে। আর এর প্রভাব পড়ছে সামগ্রিক খাদ্য চক্রের ওপরে। কিন্তু প্রাকৃতিক উপায়ে মাছ ধরলে খাদ্য চক্রের ওপরে খুব বেশি প্রভাব পড়ে না।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বাগেরহাটের উপ পরিচালক কৃষিবিদ মোঃ শফিকুল ইসলাম বলেন, ফাইটার, রিপকর্ড এবং পেসিকল নামের কীটনাশক কৃষিকাজের জন্য ব্যবহার হলেও এসব কীটনাশক দিয়েই অসাধু জেলেরা সুন্দরবনের বিভিন্ন খালে প্রয়োগ করে মাছ শিকার করে থাকে। বাগেরহাট সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. প্রদীপ কুমার বকসী বলেন, বিষ প্রয়োগে ধরা মাছ মানুষের জন্য বেশি ক্ষতিকর। এসব মাছ খেলে কিডনি, যকৃৎ, হৃৎপিন্ড অকেজোর মতো জটিল রোগে আক্রান্তের আশংকা থাকে, দীর্ঘমেয়াদে খেলে ক্যানসারও হতে পারে।
কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের জোনাল কমান্ডার রিয়ার এডমিরাল এম আশরাফুল হক বলেন, কিছু জেলে বিষ প্রয়োগ করে মাছ ধরে। আমরা বিভিন্ন সময়ে অভিযান চালিয়ে তাদেরকে আটক করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে হস্তান্তর করি। তবে কৌশলে অল্প সময়ের মধ্যে অনেকে বিষ দিয়ে মাছ ধরে নিয়ে যায়।
পূর্ব সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, বিষ দিয়ে মাছ শিকারির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রতিটি ক্যাম্প ও স্টেশনের বনরক্ষীদের কঠোর নির্দেশনা দেয়া রয়েছে। স্মার্ট পেট্রল টিমের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। বিষ দিয়ে মাছ ধরায় গত এক বছরে অর্ধশত জেলেকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। এরপরও কিছু তৎপরতা রয়েছে। স্থানীয়দের সহযোগিতা ছাড়া এদের নির্মূল করা সম্ভব নয়। বন বিভাগের কেউ কেউ জড়িত রয়েছেন বলে যে অভিযোগ উঠেছে, এর সত্যতা মিললে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এমকে