‘কেউ কবার পারিচ্ছে না লাশগুলার মধ্যে কুন্ডা হামার ছোল’

১৫ ডিসেম্বর ২০২১

দীপক কুমার সরকার, বগুড়া:

স্বামী-স্ত্রী অসুস্থ, অভাবী সংসার। তাই ছেলের ইচ্ছা না থাকলেও জোর করেই পাঠাতাম কারখানায়। আগুন লাগিছে, হামার ছোলডাও মনে হয় আগুনে পুড়া মরা গেছে। সকালে হাসিমুখে কামোত বের হলে। এখন হামাকোক কান্দা লাগিচ্ছে ছোলডার জন্নি। কেউ কবার পারিচ্ছে না- লাশগুলার মধ্যে কুন্ডা হামার ছোল। ১২টার দিকে আগুন লাগে। তারপর আর কোনো খোঁজ পাচ্ছি না তার। কথাগুলো বগুড়ার আদমদিঘীর বিআইআরএস’র প্লাস্টিক কারখানার শ্রমিক ১৫ বছরের সিহাবের বাবা লুৎফর রহমানের। তিনি যখন কথাগুলো বলছিলেন, তখন তার স্ত্রীসহ স্বজনেরা কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে লুটে পড়ে মূর্ছা যাচ্ছেন বারবার।

সিহাবের বাড়ি আদমদীঘি উপজেলার কমলদুগাছী গ্রামে, লুৎফর রহমানের ছোট ছেলে সে। পরিবারে তিন ছেলে প্রতিবন্ধী হওয়ায় একটু সচ্ছলতার আশায় সিহাবকেও কাজে পাঠাতো তার পরিবার।

উপজেলার সান্তাহারে হবির মোড় এলাকার এ কারখানায় মঙ্গলবার (১৪ ডিসেম্বর) বিকালে আগুন লাগে। এ দুর্ঘটনায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছে অন্তত ৫ শ্রমিক, নিখোঁজ রয়েছেন সিহাবসহ ৩জন। পুড়েছে কারখানাটির কোটি কোটি  টাকার সম্পদ। মারা যাওয়া ৫ জন হচ্ছে- কারখানা মালিক ও সান্তাহার পৌর মেয়র তোফাজ্জল হোসেন ভুট্টুর চাচাতো বোনের স্বামী বেলাল (৪৩), সিয়াম (১৩), শাজাহান (২৪), বিজয় (১৪) ও  আব্দুল খালেকের (৩৫)। নিখোঁজ বাকি দুজন হচ্ছে- পালোয়ান পাড়ার বাসানের ছেলে রিমন (১৫) ও সান্দিরা গ্রামের নাসির উদ্দিনের ছেলে শাহজাহান (২৯)। এ কারখানার পরিবেশগত ছাড়পত্র এবং প্লাস্টিক উৎপাদনের অনুমতি নেই। মঙ্গলবার (১৪ ডিসেম্বর) বিকালে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন পরিবেশ অধিদফতর রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক সুফিয়া নাজিম।

কারখানার মালিক তোফাজ্জল হোসেন ভুট্ট জানান, আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে ১৫-২০ জন শ্রমিক বেরিয়ে যায়। পাঁচজন মারা গেছে। নিখোঁজদের বিষয়ে জানা সম্ভব হয়নি। মারা যাওয়াদের পরিবারের পাশে থাকবেন বলে তিনি। তিনি জানান, কারখানায় ওয়ানটাই প্লেট সামগ্রি তৈরি হতো। আগুনে কারখানার কাঁচামাল পুড়ে যাওয়ায় প্রায় ৩০-৩৫ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে ধারণা করছি।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, কারখানার বয়স তিন  হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়েছে এক বছর আগে। দিন-রাত মিলে ৩৫ জন করে দুই শিফটে ৭০ জন শ্রমিক কাজ করেন। কারখানার ভেতরে পশ্চিম দিকে প্লাস্টিকের কাঁচামাল রাখার জায়গা থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। মুহূর্তের মধ্যেই চারদিকেই ছড়ায় আগুন। এ সময় শ্রমিকরা হুড়োহুড়ি করে বের হন। ফায়ার সার্ভিসের নওগাঁ, আত্রাই, রানীনগর, আদমদীঘি, দুপচাচিয়া মিলে ১২টি ইউনিট প্রায় আড়াই ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।

নওগাঁ ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক একেএম মুরশেদ বলেন, কীভাবে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে তা এখনো বলা সম্ভব না। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। পাঁচজন শ্রমিকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। ডিএনএ পরীক্ষার জন্য মরদেহ বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে।

এদিকে এ দুর্ঘটনায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) সালাউদ্দিন আহমেদকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী ৭ কর্মদিবসের মধ্যে কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

এমকে

 

 


মন্তব্য
জেলার খবর