ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, যে প্রভাব পড়বে বাংলাদেশে

০২ মার্চ ২০২২

বিশ্বের যেসব দেশের সাথে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য বা আমদানি-রপ্তানি বেশি হয়, টাকার অংকে সেই তালিকার শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে নেই রাশিয়া বা ইউক্রেন।

 

কিন্তু দুইটি দেশের সঙ্গেই বাংলাদেশের বাণিজ্য রয়েছে। যদিও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত নিরপেক্ষ অবস্থান ধরে রেখেছে।

 

কিন্তু বিশ্বায়নের এ যুগে পৃথিবীর যেকোনো দেশের মধ্যে সংঘাতের প্রভাব অন্য দেশগুলোর ওপরেও ছড়িয়ে যায়। বাংলাদেশের বিশ্লেষকরা বলছেন, রাশিয়া, ইউক্রেন ও পশ্চিমা দেশগুলোর এ সংঘাতে বাংলাদেশে তেল, গ্যাস, খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।

 

আন্তর্জাতিক বেঞ্চ মার্ক বেরেন্ট ক্রুডের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্ববাজারে এখন প্রতি ব্যারেল তেলের দাম একশো পাঁচ ডলার পর্যন্ত উঠে গেছে।

 

পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বর্তমানে যে দামে জ্বালানি তেল কিনে বাংলাদেশে নিজেদের বাজারে বিক্রি করছে, তাতে প্রতিদিন ১৫ কোটি ডলার লোকসান গুনতে হচ্ছে।

 

আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে গত বছরেই ডিজেলের দাম এক দফা বাড়িয়েছে বাংলাদেশের সরকার।

 

যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে আর বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম আরও বাড়লে হয়তো তখন দেশের বাজারে মূল্য সমন্বয়ের চেষ্টা করবে সরকারগুলো। আর দেশের বাজারে দাম বাড়লে তার প্রভাবে পরিবহনের ভাড়া বাড়বে। পণ্য পরিবহনে খরচ বেশি হলে সেগুলোর দাম বাড়বে, যাত্রীদের বেশি ভাড়া গুণতে হবে, এমনকি কৃষি উৎপাদনেও খরচ বেড়ে যাবে।

 

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলছেন, ‘এর আগে যখন ডিজেলের দাম বাড়ানো হলো, তখন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম ছিল ৮০ ডলার। সেখানেই ডিজেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। এখন তেলের দাম যে হারে বেড়েছে, যুদ্ধের কারণে সেটা আরও বাড়তে পারে।’

 

‘তখন তো আমাদের এখানেও মূল্য সমন্বয় করা ছাড়া বিকল্প থাকবে না। আর স্বাভাবিকভাবেই তেলের দাম বাড়লে পরিবহন খরচ বাড়বে। তখন পণ্যের দাম, যাত্রীদের ভাড়া, উৎপাদন খরচ- সব কিছুই বেড়ে যাবে।’ যোগ করেন তিনি।

 

বাংলাদেশ বর্তমানে প্রতি বছর ৫০ লাখ টন ডিজেল, ১৩ লাখ টন অপরিশোধিত তেল, ২ লাখ টন ফার্নেস অয়েল ও ১ লাখ ২০ হাজার টন অকটেন আমদানি করে থাকে।

 

বাংলাদেশ মূলত সৌদি আরব ও আবুধাবি থেকে জ্বালানি তেল আমদানি করে থাকে। এছাড়া সিঙ্গাপুর থেকে ফার্নেস অয়েল আমদানি করে।

 

গ্যাসের দাম দ্বিগুণের প্রস্তাব

বিশ্ববাজারে এলএনজি গ্যাসের দামও বেড়েছে। যদিও বিদেশি একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গ্যাস কেনার দশ বছরের চুক্তি রয়েছে বাংলাদেশের, ফলে গ্যাসের দামে হয়তো এখনি বড় প্রভাব ফেলবে না। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি মিলিয়ন ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট (এমএমবিটিউ) কিনছে ১১ ডলারে।

 

কিন্তু গত ফেব্রুয়ারিতে যে অল্প কিছু গ্যাস মুক্ত বাজার থেকে কিনেছে বাংলাদেশে, সেখানে প্রতি এমএমবিটিউ দিতে হয়েছে ৩০ ডলার।

 

বাংলাদেশের গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো এর মধ্যেই গ্যাসের দাম প্রায় দ্বিগুণ করার প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে। আগামী ২১ মার্চ থেকে এ বিষয়ে চারদিনের গণশুনানি শুরু করতে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।

 

রাশিয়া বিশ্বের সবচেয়ে বড় গ্যাসের সরবরাহকারী, যদিও দেশটির প্রধান ক্রেতা ইউরোপের দেশগুলো। সেসব দেশের ৪০ শতাংশ গ্যাসের যোগান আশে রাশিয়া থেকে।

 

কিন্তু একের পর রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞা জারি করছে। সেখানে রাশিয়ার গ্যাস বা তেলেরও ওপরে এখনো সরাসরি কোনো নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়নি। কিন্তু অর্থনৈতিক নানা নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার গ্যাসের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হলে এসব দেশ মুক্ত বাজার থেকে গ্যাস কিনবে।

 

ফলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, মুক্ত বাজারে গ্যাসের দাম আরও বেড়ে যেতে পারে। সেই মূল্য হয়তো তখন বাংলাদেশের গ্যাসের দাম বৃদ্ধির শুনানিতে একটি প্রভাবক হয়ে দেখা দিতে পারে।

 

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলছেন, ‘এটা অবশ্যই বাংলাদেশের ওপর চাপ তৈরি করবে। কারণ ইউরোপে রাশিয়ার গ্যাসের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হলে তারা চাইবে, যেকোনো জায়গা থেকে গ্যাস সেখানে নিয়ে যেতে। তখন আমরা যেসব মার্কেট থেকে সহজে গ্যাস পেতাম, তখন আর সেই দামে সহজে পাবো না।’

 

‘তখন তাদের সাথে প্রতিযোগিতা করে আমাদের গ্যাস কিনতে হবে, এলএনজির দাম অতি চড়া দামে কিনতে হবে। ফলে এখানে গ্যাসের দামও বাড়বে, একটা ক্রাইসিসও তৈরি হবে।’

 

 

বিদ্যুতের দাম বাড়লে সবকিছুর দাম বাড়বে

তেল ও গ্যাসের দামের সাথে অনেকটাই সম্পর্ক রয়েছে বিদ্যুতের দামের। কারণ বাংলাদেশে বিদ্যুতের একটি বড় অংশ উৎপাদনে এ দুইটি জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

 

তেল ও গ্যাসের দাম বাড়লে সরকারের সামনে বিকল্প থাকবে দুইটি। এ খাতে ভর্তুকির পরিমাণ আরও বাড়িয়ে দেয়া। কিন্তু সেক্ষেত্রে সরকারের অন্যান্য খাত থেকে খরচ কমিয়ে এনে এ খাতে ব্যবহার করতে হবে। ফলে উন্নয়ন বা অন্যান্য প্রকল্প বাধাগ্রস্ত হতে পারে। অথবা জ্বালানি পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দেয়া।

 

প্রথমটি করা হলে যেমন সরকারের খরচ বাড়বে, দ্বিতীয়টি করার হলে জনগণের খরচ বহুগুণ বেড়ে যাবে। সেই সঙ্গে মূল্যস্ফীতিও বেড়ে যাবে।

 

গমের সংকট তৈরি হলে প্রভাব পড়বে খাদ্য পণ্যে

আমদানি ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে প্রতি বছর প্রায় ১১০ কোটি ডলারের বাণিজ্য হয়ে থাকে। রাশিয়া থেকে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি আমদানি করে গম। ইউক্রেন থেকেও এই পণ্যটি বাংলাদেশ আমদানি করে।

 

বাংলাদেশের গমের মোট চাহিদার এক তৃতীয়াংশ আসে এই দুইটি দেশ থেকে, বলছেন বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্প গ্রুপ সিটি গ্রুপের একজন পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা।

 

প্রতি বছর এ দুইটি দেশ থেকে প্রায় একশো কোটি টন গম বাংলাদেশে আসে। কিন্তু এই যুদ্ধের কারণে গমের সেই সরবরাহ নিয়ে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

 

দেশের মোট ভুট্টার চাহিদার ২০ শতাংশ আসে এ দুইটি দেশ থেকে। সূর্যমুখী তেলের আশি শতাংশই আসে এ দুইটি দেশ থেকে।

 

রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা দেশগুলোর জারি করা নিষেধাজ্ঞার ফলে সরাসরি এসব পণ্য কেনা কঠিন হয়ে উঠতে পারে।

 

যুদ্ধের কারণে এর মধ্যেই গম, সূর্যমুখী তেল আর ভুট্টার দাম বাড়তে শুরু করেছে। গম থেকেই ময়দা, আটা, সুজিসহ বিভিন্ন খাদ্যজাত পণ্য তৈরি করা হয়।

 

এর বাইরে তুলা, সরিষা ও মসুর ডাল রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে আমদানি করা হয়।

 

প্রভাব পড়বে রপ্তানিতে পণ্যে

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের নতুন বাজার হিসেবে দেখা হচ্ছে রাশিয়াকে। গত বছর বাংলাদেশ থেকে রাশিয়ায় যে ৭৮ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, তার মধ্যে তৈরি পোশাকই সবচেয়ে বেশি। গত বছর বাংলাদেশ থেকে রাশিয়ায় ৬০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে।

 

তবে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা আশঙ্কা করছেন, এ যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে তাদের রপ্তানির ওপর বিরূপ প্রভাব তৈরি করবে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি কারক ও কারখানা মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সাবেক সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলছেন, ‘আমরা এর মধ্যেই চিন্তায় পড়ে গেছি। কারণ সুইফট সিস্টেম থেকে রাশিয়াকে বাদ দেয়া হলে আমাদের পাওনা পাওয়া নিয়ে জটিলতা তৈরি হবে। আবার রাশিয়ায় যদি জাহাজ বা বিমান পাঠানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়, তাহলে তো এখানে তৈরি করা পোশাকও তো আমরা পাঠাতে পারবো না।’

 

তিনি জানান, তেলের অব্যাহত দাম বৃদ্ধির কারণে তারাও চিন্তায় রয়েছেন। কারণ এর ফলে জাহাজ ভাড়া বাড়ছে। অন্যদিকে যে দামে তারা পোশাক রপ্তানির আদেশ নিয়েছেন, সেখানেও উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে।

 

সূত্র : বিবিসি


মন্তব্য
জেলার খবর